খেলাধুলা সামাজিকীকরণের অন্যতম একটা মাধ্যম। বর্তমান সময়ে খেলাধুলার কথা বললেই আমাদের মাথায় যে খেলার নাম চলে আসে, সেটা হয় ক্রিকেট নয়তো ফুটবল। এটা যদিও শহরের দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু গ্রামও আর পিছিয়ে নেই। তাদের মধ্যেও এই ধারণার অনুপ্রবেশ করেছে ভালোভাবেই। আর এসব খেলাধুলার জন্য গড়ে উঠেছিল ক্লাবগুলো। এসব ক্লাবের অনেক ঐতিহ্য আছে, এর মধ্যে শতবর্ষী ক্লাবও আছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে ক্লাব থেকে খেলাধুলা বিদায় নিয়েছে, সেখানে গোপনে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার আসর বা ক্যাসিনো। কখনোই বোঝোই যায়নি ভেতরে এসব অবৈধ কাজ চলছে। কিন্তু এই তথ্য ছিল সরকারের কাছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা জানিয়ে দিয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু হলে বেরিয়ে আসে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলো খেলাধুলার নামে চালিয়ে যাওয়া জুয়াখেলা বা ক্যাসিনো এবং নানা অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হওয়ার ভয়ংকর সব কথা।
গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর রাতে) রাজধানী ঢাকার চারটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়েছিল র্যাব পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি দল। এসময় পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাসিনোগুলো সিলগালা করার পাশাপাশি সেখান থেকে ১৮২ জনকে আটক করে। তাদের প্রত্যেককে ছয় মাস থেকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত। এছাড়া জব্দ করা হয় প্রায় ৪০ লাখ নগদ টাকা, জাল টাকা, জুয়া খেলার সরঞ্জাম, ইয়াবাসহ দেশি-বিদেশি মদ।
এই ক্যাসিনোগুলো হল- ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, মতিঝিলের ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ।
ঢাকায় র্যাবের সমন্বিত অভিযানে চারটি কথিত ‘ক্যাসিনো’ সিলগালা ও বহু মানুষকে আটকের পর জুয়াখেলা এবং ক্যাসিনো ইত্যাদি নিয়ে এখন বাংলাদেশে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে জানা যাচ্ছে ঢাকায় অন্তত ষাটটি এমন ক্যাসিনোর অস্তিত্ব রয়েছে।
অভিযান চলমান আছে, এ অভিযান শুধু রাজধানী ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশে বিস্তৃত হয়েছে। খেলাধুলার জন্য ক্লাব বা সংঘ গড়ে তোলার ইতিহাস অনেক পুরানো। ফরাসি বিপ্লবের সময় কোনো রাজনৈতিক দল না থাকাতে ক্লাবগুলো বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশ আমলে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলার জন্য ক্লাব গড়ে উঠে।
পাকিস্তান আমলে ক্লাবগুলোর খেলাধুলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হত। মুক্তিযুদ্ধে ক্লাবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে ক্লাবে অবক্ষয় দেখা দেয়। ক্লাবে অর্থ সংস্থানের জন্য সীমিত পর্যায়ে ‘হাউজি’ খেলা চালু হয়। হাউজি বড় ধরনের কোনো জুয়া নয়। এক্সিবিশনে আগে থেকে এর প্রচলন ছিল। কিন্তু হাউজি এক সময় জমে গেলে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা আস্তে আস্তে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ক্যাসিনো চালু করে, ক্যাসিনোর সাথে আর যেসব অনুষঙ্গ আছে তাও চালু হয় ফলে ক্লাবগুলো খেলাধুলার স্থলে টাকা আয়ের ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা আধা সামন্ততান্ত্রিক থেকে পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ক্যাসিনো পুঁজিবাদী সমাজের অনিবার্য অংশ। এটা জোর করে বন্ধ করে রাখা যাবে না। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন কেউ যদি বৈধভাবে ক্যাসিনো প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করে, তাহলে সরকার তা বিবেচনা করবে।
আমরা মনে করি, সরকারের এই অবস্থান ঠিক আছে। তবে কোনোভাবেই অবৈধ ক্যাসিনো চলতে পারে না, বিশেষ করে খেলাধুলার ক্লাবে। সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নও কমে যাবে।
আমরা সরকারের এই উদ্যোগকে বৈপ্লবিক উদ্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করছি এবং এর সর্বঙ্গীন সাফল্য কামনা করছি এবং আশা করছি ক্লাবগুলো আবার ক্রীড়া সংগঠকদের হাতে যাবে ও খেলাধুলা ফিরে আসবে।