একটি দেশ বা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে তরুণ জনগোষ্ঠীর সক্রিয় থাকা বাঞ্ছনীয়। তরুণ জনগোষ্ঠীর সক্রিয়তার উপরেই রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তরুণ জনগোষ্ঠীর সক্রিয়তার উপরে নির্ভর করছে তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। কিন্তু দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো সক্রিয় নয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আএলও) তাদের প্রকাশিত ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড: এশিয়া, প্যাসিফিক অ্যান্ড দ্য আরব স্টেট’ প্রতিবেদনে সে চিত্রই ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, দেশের ৪০ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয় রয়েছে। আর নিষ্ক্রিয় তরুণ জনগোষ্ঠীর তালিকায় সারা বিশ্বে মালদ্বীপ ও ইয়েমেনের পরে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
আইএলও’র প্রতিবেদনটি বলছে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৪০ শতাংশ তরুণ শিক্ষায় নেই, চাকরিতে নেই, আবার চাকরির জন্যও কোন প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। আইএলও নিষ্ক্রিয় তরুণদের হারকে একটি সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করে, যার নাম নিট। এর মানে হলো ‘নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট, অর ট্রেনিং’। কোন দেশে কতসংখ্যক তরুণ নিষ্ক্রিয়, তা সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এ ধরণের তরুণদেরই একটি অংশ সমাজ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে বলে মনে করা হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার অনেক কম। আর নিষ্ক্রিয় তরুণ জনগোষ্ঠীর তালিকায় শীর্ষে থাকা মালদ্বীপের ৫৬ শতাংশ ও এরপরে থাকা ইয়েমেনের ৪৮ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়।
যেকোন সময়ের চেয়ে বাংলাদেশে এখন তরুণদের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলেও সত্যি যে, এদের এখনো একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়নি। এছাড়াও তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে কাজ না করার প্রবণতা রয়েছে। অল্পতে হতাশ হবার প্রবণতা এ ধরণের কর্মহীনতাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাদের এ অবস্থাতে যে করণীয় কি, সে বিষয়ে তাদের কেউ পরামর্শ দিচ্ছে না। কিন্তু তার মানে কিন্তু এ নয় যে তাদের সকলের মাঝে এ প্রবণতা রয়েছে। তাদের অনেকেই কাজের অভাবেও রয়েছে। তাদের কেউ কেউ কাজ করতে চাচ্ছে কিন্তু কাজ পাচ্ছে না। আর শিক্ষিত বেকারও রয়েছে অনেক। সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে শিক্ষিত বেকারের হার শতকরা ৪৭ ভাগ। এখন এ বিপুল সংখ্যক তরুণ যদি কর্মসংস্থান না পায় তাহলে তারা তো দিনের পর দিন বেকার থেকে যাবে। আর দিনকে দিন বাড়তে থাকবে বেকারদের সংখ্যা।
‘নিষ্ক্রিয় তরুণদের একটি অংশের বিপথগামী হবার ঝুঁকি থাকে বেশি’ এ রকম ধারণাটি অমূলক নয়। বাস্তবতার নিষ্ঠুর নিয়তির কারণে এ রকম তরুণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এমনিতেই বিপথগামী হতে বাধ্য হবে। তাদের কর্মসংস্থান না হলে প্রয়োজনের তাগিদে তারা অবৈধ কর্মে লিপ্ত হতে পারে। এছাড়াও জঙ্গিগোষ্ঠীরা এসব তরুণদের দুর্বলতার কারণে তাদের দলে ভিড়াতে সক্ষম হবে। তখন দেশের পরিস্থিতি যে আরো খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। শুধু তাই নয়, এসব নিষ্ক্রিয় তরুণদের আরো একটি অংশ হতাশায় মাদকাশক্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তখন সামাজে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তাই এসব সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এ সমস্যাকে কোনভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) তরুণদের সক্রিয়তার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসডিজির ৮ নম্বর লক্ষ্যটি হলো, ‘শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক উন্নতি’। এ লক্ষ্যের অধীনে ২০২০ সালের মধ্যে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চাইলে নিষ্ক্রিয় তরুণদের কর্মবাজারে নিয়ে আসতে হবে। দেশের ৪০% তরুণ নিষ্ক্রিয়; অর্থাৎ, ৬০ শতাংশ তরুণ কোন না কোনভাবে সক্রিয় আছে। এখন নিষ্ক্রিয় তরুণদের সক্রিয় করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন দিকে উদ্যোগ নিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে সব দিক থেকে। প্রশিক্ষণের বিষয়ে থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সেন্টার। কর্মময় জীবনকে সহজ করতে সামাজিকভাবে কিছু সুবিধা তৈরি করতে হবে। তাহলেই সক্রিয় তরুণদের সংখ্যা আরো বাড়বে। আর নিষ্ক্রিয় তরুণদের সক্রিয় করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিও যেমন বাড়বে তেমনি দেশ বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও মুক্তি পাবে।