দেশে যত সড়ক দুর্ঘটনা হয় তার বেশিরভাগই হয়ে থাকে চালকের অসাবধানতার কারণে। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য মতে, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ। অার সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে।
গত শুক্রবার রাতে ফরিদপুরে ও চলতি সপ্তাহের রোববার নরসিংদীতে ঘটে যাওয়া দুটি বড় সড়ক দুর্ঘটনার পেছনেও অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবকে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুটি দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণ গেছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২ হাজার ৩৯৪ জনের। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা ৮ হাজার। সবমিলিয়ে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের প্রাণ ঝরছে। এসব পরিস্থিতির বিবেচনায় দেশের সড়ক ব্যবস্থা যে একেবারেই নাজুক তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বার বার আলোচনা করা হলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রথমেই বলা যায়, অদক্ষ চালক নিয়োগ। যারা চালক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে তাদের অনেকেরই কোন প্রশিক্ষণ নেই। কোনভাবে একটি ধারণা নিয়ে চালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। আবার অবৈধ চালক রয়েছে অনেক। যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সের সংখ্যা কম। বর্তমানে সারা দেশে চালকের লাইসেন্স আছে ১৭ লাখ। আর যানবাহনের সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। যানবাহনের চেয়ে লাইসেন্স কম ১০ লাখ। এ রকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনাকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার জন্য সরকারের দূরদর্শিতারও পর্যাপ্ত অভাব রয়েছে। প্রতিবারই বলা হয়, পরিকল্পনা নেয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা আর দেখা যায় না। এ ছাড়াও সড়ক খাতের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দও যথেষ্ট নয়। ফলে কোনভাবেই এর উন্নয়ন হতে দেখা যায় না। এ রকম পরিস্থিতি চলবে আর কতদিন?
এ রকম দু:সহনীয় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরন করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা ধাপে ধাপে গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমে যারা সড়কে বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালায় তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি আইন আরো কঠোর করতে হবে। যেন আইনের কঠোরতার কারণে যে কেউ হরহামেশাই অতি গতিতে গাড়ি না চালায়। লাইসেন্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে তার আগে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনভাবেই যেন কেউ লাইসেন্স না পায় সে রকম ব্যবস্থাও করতে হবে। যারা অবৈধভাবে যানবাহন চালাচ্ছে এবং অবৈধ উপায়ে লাইসেন্স দিচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এসব কিছু করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়ক ব্যবস্থারও উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি সড়কে ট্রাফিক পুলিশের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। এতে করে নজরদারির একটি ভাল ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে বলা যায়।
সবকিছুর ব্যবস্থা একদিনে করা সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে দৃঢ়ভাবে উদ্যোগ নিলে সময় অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা থাকতে হবে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচেতেন হতে হবে। অনেকেই আছে যেন তেন ভাবে গাড়ি চালান। মনে রাখতে হবে, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। দেশের নাগরিক হিসেবে ট্রাফিক আইন মেনে চলার মানসিকতা থাকতে হবে। শুধু, দেশের সড়কগুলো নিরাপদ রাখা সরকারের একার দায়িত্ব নয় কিংবা সরকারের একার পক্ষেও সম্ভব নয়। দেশের মানুষ হিসেবে এখানেও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে সে কথা আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে।