অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সাপের কামড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। দেখা গেছে, প্রতি বন্যার সময় অর্থাৎ মে, জুন এবং জুলাই এই তিন মাস সাপের দংশন এবং তার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। শহরের চেয়ে গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ সচেতনতার অভাব, সঠিক চিকিৎসার অভাব বা চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হওয়া।
এখনো অনেক গ্রামে কুসংস্কার আছে, সাপে কাটলে ওঝা বা বেদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনেকেই সাপে কাটলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীভাবে চিকিৎসা নিতে হবে বা সাপে কাটলে করণীয় কী তা জানেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, শুধু সঠিক জ্ঞানের অভাবে মারা যান।
বন্যপ্রাণী বিশেষ করে সাপ এবং সাপের দংশনজনিত মৃত্যু এবং শারীরিক ও মানসিক আঘাত নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ এলাকায় সাপের কামড় এবং তা থেকে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।
বাংলাদেশে কোন সাপ বেশি বিষধর?
বাংলাদেশে ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজ বলেছেন, দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায়।
সাপে কাটার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে, এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি ঘটে থাকে। স্থলভূমিতে থাকা সাপ পায়ে বেশি দংশন করে। সামুদ্রিক সাপও অত্যন্ত বিষাক্ত হয়।
বাংলাদেশে ২৩ ধরণের সামুদ্রিক সাপ রয়েছে, সেগুলো মাছ ধরতে সমুদ্রে যাওয়া জেলেদের দংশন করে। তবে সমুদ্রের গভীরে তাদের অবস্থান হওয়ায় সাধারণত এই সাপের কামড়ের ঘটনা বিরল।
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যত মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়, তার চারগুণ মানুষের নানা রকম অঙ্গহানি ঘটে, কেউ শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান, এবং কেউ দীর্ঘদিন মানসিক ট্রমা ভোগ করেন।
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী যে সাত প্রজাতির বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায়:
১. নায়া নায়া
এটি কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ, এর বৈজ্ঞানিক নাম নায়া নায়া। এটি স্থলভূমির সাপ, এটি ফণা তোলে এবং এর ফণায় চশমার মত দুইটি বলয় থাকে। দেশের পশ্চিম অংশেই অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চলের দিকে প্রধানত এ সাপের বসবাস।
২. নায়া কাউচিয়া
এটিও গোখরা প্রজাতির সাপ, স্থানীয়ভাবে একে জাতি সাপ বা জাত সাপও বলে থাকে। এই সাপটিকে জউরা নামেও ডাকা হয়। এ সাপ ফণা তোলে। এটি মূলত দেশের পূর্ব অংশ অর্থাৎ সিলেট, নোয়াখালী এলাকায় বেশি থাকে। দেশে যত সর্প দংশনের ঘটনা ঘটে, এর কামড়ে ঘটে সর্বোচ্চ।
৩. কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়
একে রাজ গোখরাও বলা হয়। ভয়াবহ বিষধর এই শঙ্খচূড় অন্য গোখরার তুলনায় আকৃতিতে বেশ লম্বা। এর ফণায় অন্য গোখরার মতো চশমার মত বলয় থাকে না। শঙ্খচূড় বাংলাদেশ, ভুটান, বার্মা, কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এসব দেশে বেশি দেখা যায়। এই সাপ ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ি এলাকায় থাকতে পছন্দ করে।
৪. ক্রেইট বা শঙ্খিনী
এই সাপকে শঙ্খিনী এবং শাঁকিনী সাপ নামেও ডাকা হয়। পৃথিবীতে ক্রেইট বা শঙ্খিনী জাতের সাপের মোট ৮টি প্রজাতি রয়েছে, এর মধ্যে ৫টি প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এই ক্রেইট জাতের সাপকে স্থানীয়ভাবে কেউটেও বলা হয়। এ সাপ বাড়ির আশপাশে বা লাকড়ির মধ্যে শুকনো জায়গায় থাকে।
৫. কালো নাইজার
এটিও শঙ্খিনী জাতের সাপ এবং বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে এই সাপ। এটি চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চল, নোয়াখালী এবং সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায় বেশি।
৬. চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার
চন্দ্রবোড়ার আরেক নাম উলুবোড়া। বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখা যায়, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বিষাক্ত। এই সাপটি প্রায় একশো বছর আগে বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, অর্থাৎ পরপর কয়েক দশকে এর কোন একটি সাপেরও দেখা মেলেনি। কিন্তু গত ১০/১২ বছর আগে থেকে আবার এই সাপে দংশনের ঘটনা ঘটার প্রমাণ দেখা যায়।
অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে এই সাপটি বেশি দেখা যায় বলে জানান সাপ গবেষকরা। ২০২১ সালে আবার দেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী কয়েকটি জেলা ও চরাঞ্চলে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে দুইজন নিহত ও কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা সে সময় বেশ আলোড়ন তুলেছিল।
এ বছর আবার মানিকগঞ্জে এই সাপের কামড়ে গত তিন মাসে পাঁচজন মারা গেছে বলে জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। যারা মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই কৃষক বলে জানিয়েছেন তারা। কারণ এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। ফলে ফসলের ক্ষেতে স্বাভাবিকভাবেই সাপের উপদ্রব হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, “পদ্মার অববাহিকা ধরেই মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলে গেছে রাসেলস ভাইপার সাপ”। এদিকে, রাজশাহীতে এই সপ্তাহেই সাপের কামড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ধান কাটার এই মৌসুমে পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছে কৃষকরা।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সারদায় পদ্মার পাড়ে অবস্থিত পুলিশ একাডেমি চত্বর থেকে রোববার আটটি রাসেলস ভাইপার সাপের বাচ্চা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে পুলিশ সদস্যরা পিটিয়ে সাপের বাচ্চাগুলো মেরে ফেলেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
টক্সিকোলজি সোসাইটির অধ্যাপক ফায়েজ বলছিলেন, প্রথমে রাজশাহী অঞ্চলে এই সাপের অস্তিত্বের প্রমাণ মিললেও, এখন এই সাপ বেড়ে ক্রমে ফরিদপুর অঞ্চল পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই সাপ হঠাৎ করে কেন আর কিভাবে ফেরত এসেছে, তা নিয়ে এখন বাংলাদেশে গবেষণা চলছে। এই সাপ কাটলে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে, রক্ত জমাট বেধে যায়।
৭. সবুজ বোড়া
সবুজ বোড়া বা গ্রিন ভাইপার সাপকে স্থানীয়ভাবে গাল টাউয়া সাপও বলে। এর মাথার অংশ মোটা বলে এই নামকরণ। এই জাতের মোট ছয়টি প্রজাতি বাংলাদেশে দেখা যায়। এই সাপ সুন্দরবন এবং পাহাড়ি এলাকার জঙ্গলে থাকে বলে এটি মানুষের মুখে মাথায় এবং গায়ে দংশন করে। এর দংশনে স্নায়ু ও মাংসপেশীতে রক্তপাত হয়, এবং মস্তিষ্কে প্রচণ্ড আঘাত লাগে।
সাপে কাটার প্রতিকার
সাপে কাটলেই মানুষের মৃত্যু হবে এমন একটি প্রচলিত ভুল ধারণা চালু আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ সর্প দংশনের ক্ষেত্রে সাপ থাকে নির্বিষ। ফলে সাপে কাটলেই মৃত্যু হবে এমন ধারণা সঠিক নয়।
তবে, সাপ যদি দংশন করে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব সাপে কামড়ানোর ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে যে অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা হয়, তা মূলত ভারতের তামিলনাড়ু থেকে আসে।
অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান বলেছেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় বছরে পাঁচ কোটি টাকার কিছু বেশি পরিমাণ অ্যান্টিভেনম আমদানি করা হয় দেশে। তবে, এই অ্যান্টিভেনম ‘অনুপযুক্ত’এবং ‘অপ্রয়োজনীয়’ — এমন সমালোচনা রয়েছে।
টক্সিকোলজি সোসাইটির অধ্যাপক ফায়েজ বলছিলেন, বাংলাদেশে যে অ্যান্টিভেনম আনা হয়, সেটি মূলত চারটি সাপের বিষের একটি ‘ককটেল’ বা মিশ্রণ, যা কিছু সাপের দংশন নিরাময়ে কাজ করে। বাকি ক্ষেত্রে সেগুলো আংশিক কাজ করে।
“এটি একেবারেই যথার্থ নয়। তামিলনাড়ু স্থানীয় সাপের বিষ দিয়ে তারা তাদের অ্যান্টিভেনম তৈরি করে থাকে।
সেখানকার সাপ এবং সাপের বিষের সাথে আমাদের দেশের সাপের বিষে ফারাক আছে। ভারত থেকে যে অ্যান্টিভেনম আনা হয়, তার মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে।”
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে, যেখানকার মানুষকে সাপ কেটেছে, সেখানকার স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি করে চিকিৎসা দিতে হবে। না হলে তা কার্যকর হয় না। তবে, প্রতি বছর বন্যার সময় বিশেষ করে সাপে কাটার প্রচুর ঘটনা ঘটলেও এখনো অ্যান্টিভেনম কেবলমাত্র জেলা শহর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সদর হাসপাতালে থাকে। প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে সরবারহ করা হয়।
সাপে কাটলে কী করবেন?
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ যিনি সাপের দংশন এবং অ্যান্টিভেনম নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি বলছিলেন, সাপ কাটলে কী করতে হবে, তার সঙ্গে কী করবেন না—দুইটাই জেনে রাখতে হবে।
তার পরামর্শ হচ্ছে—
কী করবেন
- দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন
- হাত বা পা ভাঙলে যেমন করে শক্ত কিছু দিয়ে কাপড় দিয়ে হালকা করে বাধা হয়, সেভাবে বাধুন
- সাপে কাটা পেশী যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন, পেশীর নড়াচড়া যত কম হবে, বিষ তত কম ছড়াবে।
কী করবেন না
- *আতংকিত হওয়া যাবে না
- *ওঝা বা ঝাড়ফুঁকের অপেক্ষা করে কালক্ষেপণ করবেন না
- *চিকিৎসক দেখার আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া উচিত না
- *কোন মলম বা মালিশ লাগানো উচিত না
- *সাপে কাটা জায়গায় শক্ত করে বাঁধা, কারণ রক্ত জমে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিভেনম
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালে অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। এর আগে ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ঘোষ এই অ্যান্টিভেনম প্রকল্পের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, তিনি বলছিলেন প্রকল্পের জরিপের কাজ অর্থাৎ দেশি সাপের প্রায় সব ধরণের প্রজাতির ওপর জরিপ চালানো শেষ হয়েছে।
এছাড়া সবচেয়ে বিষধর সাপের প্রজাতি সংগ্রহ এবং সেগুলোর লালনপালনের জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দেয়া এ ধরণের কাজ চলছে।
বিষধর সাপের জীবনযাপন ও দংশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি জানার পরই অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজটি সফল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সূত্র-বিবিসি।