ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক: নিউ ইয়র্কে সাকিব আল হাসানের নানা অপকর্মের কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বাংলাদেশের ভরাডুবি হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতেই নিউ ইয়র্কে আসার পর প্রয়োজনীয় অনুশীলন না করেই বার্বিকিউ পার্টি, পিকনিক আর তহবিল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে উঠেন সাকিব-শান্তরা। অন্যান্য দলের বিপক্ষে খেলা নিয়ে কোন ভাবনাই ছিল নেই তাদের মাথায়।
শনিবার (৮ জুন) রাতে সেন্ট জোনস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাসের মানব পাচারকারী, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের একত্রে জড়ো করে তার ক্যান্সার হাসপাতালে তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠান করার ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন সাকিব। এর আগে ২ জুন নিউ ইয়র্কের নাসাউ কাউন্টির নিজ বাড়িতে প্রবাসী বাংলাদেশি তথাকথিত কমিউনিটি নেতাদের মুরগির ঝলসানো মাংস (বারবাকিউ) খাওয়ানোর আয়োজন করেন। এ নিয়েও বেশ সমালোচিত হয়েছেন সাকিব আল হাসান।
সাকিব আল হাসান এবার নিউ ইয়র্কে এসে বিভিন্ন পার্টি ও সমাবেশের নামে তহবিল সংগ্রহের নামে চাঁদাবাজি করলেও এবারের কৌশলে একেবারে ভিন্ন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামো ও ভিত্তি প্রস্তরহীন বাংলাদেশের মাগুরায় নিজের নামে ক্যান্সার হাসপাতালের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন দেশে-বিদেশে। তার সেই ক্যান্সার হাসপাতালের নামকে সংশোধন করে শুধুমাত্র তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ‘সাকিব আল হাসান ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ইন্ক’ নামে একটি সংস্থা চালু করেছেন নিউ ইয়র্কে। সাকিবের ঠান্ডা মাথায় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার উঠেছে নিউ ইয়র্কের প্রবাসীরা। তারা নিউ ইয়র্ক স্টেট এটর্নি জেনারেল অফিসে বিষয়টি অবহিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় অর্থে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রে খেলতে এসে টিমের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিউইয়র্কস্থ সেকেন্ড হোমে নিয়মিত আয়োজন চলছে পার্টি আর পিকনিকের। নিউ ইয়র্কের সেন্ট জোনস ইউনিভার্সিটির বলরুমে গত ৮ জুন সন্ধায় ‘সাকিব আল হাসান ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ইন্ক’র ব্যানারে তহবিল সংগ্রহ নৈশ্যভোজের আয়োজন করে আদায় করেন মোটা অংকের অর্থ। সাকিব আল হাসান ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ইন্ক নামের কোম্পানীটি সম্পূর্ন নতুন। নিউ ইয়র্ক স্টেটে অলাভজনক কোম্পানী হিসেবে সার্টিফিকেশনের জন্য গত ৭ মে তিনি তড়িঘড়ি করে আবেদন করেন। পরদিন ৮ মে কোম্পানীটি নথিভূক্ত করা হয়েছে বলে স্টেটের ওয়েব সাইট সূত্রে জানা গেছে। নিউ ইয়র্ক স্টেটভূক্ত তার কোম্পানীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৭৩২৪৭৬৭। তবে কোম্পানীটিকে করমুক্ত সুবিধা পেতে হলে কম করে হলেও আরো ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে।
‘সাকিব আল হাসান ক্যান্সার ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ওয়েব সাইট রয়েছে। কিন্তু ক্যান্সার হাসপাতাল প্রকল্পের নূন্যতম কোন তথ্য নেই তাতে। আছে শুধু অনুদানের আহ্বান। সাকিব আল হাসান মাগুরায় হাসপাতালের কোন ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেননি এখনো। প্রাথমিকভাবে পাঁচ দশ কোটি টাকা তাতে লগ্নি করেছেন এমন কোন তথ্যও নেই। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রশ্ন আন্তরিক হলে সাকিব এককভাবে নিজস্ব অর্থায়নেই প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এধরণের একটি হাসপাতাল। সেখানে ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন বা কোন পরিকল্পনা ছাড়াই কিভাবে তিনি নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তহবিল সংগ্রহ করতে চান? সরল মনে অনেকে বিষয়টি বিশ্বাস করলেও সচেতন প্রবাসীরা তহবিল সংগ্রহের আয়োজনকে দেখছেন ভিন্ন চোখে। তারা মনে করেন ক্যান্সার হাসপাতালের নামে সাকিব আসলে চাঁদাবাজিতে নেমেছেন।
এসবের আড়ালে তিনি এঁটেছেন ভিন্ন ফন্দি। অর্থ পাচার, শেয়ার বাজার কেলেকাংকারী, অন্যের জমি দখল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঘটনের নায়ক সাকিব কৌশলে প্রবাসীদের অর্থ হাতিয়ে নিতে চান বলে তাদের অভিযোগ। বিষয়টি তারা নিউ ইয়র্ক স্টেট এটর্নি জেনারেল অফিসকে অবহিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যে সাকিব আল হাসান ক্যান্সার ফাউন্ডেশন ইউকে নামে একটি চ্যারিটি কমিশন নিবন্ধন করা হয়েছে ২০২৩ এর ২২ ডিসেম্বর। চ্যারিটি নাম্বার ১২০৬৩৩৪। কিন্তু এই তহবিলে কেউ অনুদান দিয়েছে এমনটি উল্লেখ নেই।
গত বছর ২৪ মার্চ সাকিব নিজের ৩৬তম জন্মদিনে ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন ‘সাকিব আল হাসান ক্যান্সার ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠার। যার ব্যানারে নিজের নামে মাগুরায় একটি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলতে চান তিনি। সাকিব মূলতঃ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব সেরা ক্রিকেটার ইমরান খানকেই অনুসরণের চেষ্টা করছেন। ইমরান লাহোর ও পেশোওয়ারে ক্যান্সার হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাকিবও হাঁটতে চান ইমরান খানের দেখানো পথে। তবে এজন্য প্রয়োজনীয় হোম ওয়ার্ক ও নিয়মনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই তার।
উল্লেখ্য, ইমরান খান ক্যান্সারে মৃত্যুবরণকারী তার মাতা শওকত খানমের নামে লাহোরে একটি মেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটাল এন্ড রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৪ সালে। এর আগে তিনি পাকিস্তানের ১৮৬০ এর চ্যারিটি সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্টের ২১ ধারায় নিবন্ধিত করেন প্রতিষ্ঠানটি। পুরো হাসপাতাল নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার এবং একই রাজ্যের বড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। পরবর্তীতে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন শেষে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় হাসপাতালটি। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ইমরান খান ক্যান্সার আপিল ইনক’ নামে যুক্তরাষ্ট্রে আইআরএস এর করমুক্ত পাবলিক চ্যারিটি সেকশন ৫০১(সি) (৩) অনুমতিপ্রাপ্ত হয়। ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি বর্তমানে পেশোয়ার সহ ৫০টি শহরে নিয়োজিত ক্যান্সার রোগীদের সেবায় ।
কিন্তু সাকিব আল হাসানের কল্পিত ক্যান্সার হাসপাতাল বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক নিবন্ধন প্রাপ্ত হয়েছে এমন কোন তথ্য প্রমাণ নেই তার ওয়েব সাইটে। মাগুরায় স্থাপিত হয়নি কোন ভিত্তি প্রস্তর বা অব কাঠামো। তার আগেই সাকিব যুক্তরাষ্ট্রে এসে কথিত হাসপাতালের জন্য আয়োজন করেছেন অর্থ সংগ্রহের। বাংলাদেশের একজন আইন প্রণেতা সাকিব আল হাসান বিয়ে করেছেন বাংলাদেশী আমেরিকান উম্মে আহমেদ শিশিরকে। তিনি আমেরিকার গ্রীনকার্ড পেয়েছেন ২০১৯ সালে। সাকিব গত ২০২৩ সালে নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডস্থ জেরিকো শহরে পাড়ায় প্রায় ১০ কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন একটি বিলাস বহুল বাড়ি। তার স্ত্রী ও তিন সন্তান এখানে বসবাস করছেন। অতীতে নিউ ইয়র্কে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও ভক্তদের সাথে ফটোসেশন করে অর্থ কামিয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।
সাকিবকে নিয়ে এমনো আলোচনা চাউর আছে যে ‘যেখানে টাকা সেখানেই সাকিব’। জুয়া-মদ থেকে শুরু করে নিম্নমানের কাপড়, কসমেটিক্সের দোকান তিনি উদ্বোধন করেন টাকার বিনিময়ে। ক্যারিয়ারে নানা সময়ে তিনি জন্ম দিয়েছেন নানা বিতর্কের । কখনও সতীর্থদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে, কখনো দর্শক-মিডিয়া কিংবা বোর্ডের নিয়ম ভঙ্গ করে। গত ঈদুল ফিতরে নিউইয়র্কে ঈদ জামাতে প্রবাসী কয়েকজন ক্রিকেট প্রেমী তার সাথে ছবি তুলতে চাইলে সাকিব তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন এবং এক পর্যায়ে ঈদগাহ ত্যাগ করেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন সাকিব।
এ ব্যাপারে সাকিব হাসানের মুঠোফোনের হোয়াটসঅ্যাপে যোগাগোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর ক্ষুদে বার্তায় জানতে চাওয়া হয়েছিল সাকিব আল হাসান ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ইন্ক নামের ব্যানারে ফান্ড রাইজিং ডিনারের সংগৃহীত তহবিলে দেশে কীভাবে খরচ করেছেন বা করবেন। পুর্বে সংগৃহীত তহবিলে দেশে কীভাবে খরচ করেছেন। কিন্তু কোন মতামত জানাননি সাকিব।