বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন, কর, কালোটাকা, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি—এসব নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন: নতুন মূসক বা ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ী ও এনবিআর মুখোমুখি অবস্থানে। ব্যবসায়ীদের দাবি, কম মূসক হার। এ নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আপনি কি মনে করেন, মূসক হার বেশি?
জাহিদ হোসেন: আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে ভ্যাট হার তুলনা করা কঠিন। অনেকে বলেন, ভারতে ভ্যাট হার কম। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আরোপিত ভ্যাট হার ধরলে ভারতে এটি ১৩ শতাংশের বেশি। আবার গুডস অ্যান্ড সেলস ট্যাক্স (জিএসটি) চালু করছে ভারত। জিএসটিতে চারটি হার থাকবে। আমার মতে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট মাঝারি পর্যায়ে পড়ে। তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিরোধে গিয়ে নয়, তাঁদের সঙ্গে নিয়েই নতুন আইন চালু করতে হবে। তবে মূসক হারে ছাড় দিয়ে একাধিক হার করলে ভ্যাটের মূল দর্শনটিই নষ্ট হয়ে যাবে।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ভ্যাটের একক হার হওয়া উচিত। এতে আইনটি অধিক কার্যক্ষম হবে। এতে কেউ লাভবান হবেন; আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। একাধিক ভ্যাট হার থাকলে যাঁদের লবিং আছে; তাঁরাই কম হারের তালিকায় ঢুকে পড়বেন। একক হার হলে সুবিধা হলো, এ খাতে ভ্যাট বেশি, ওই খাতে কম, এসব নিয়ে বিনিয়োগকারীকেও ভাবতে হবে না।
আইনটি বাস্তবায়নের স্বার্থে জনপ্রিয় না হলেও একক হারে ভ্যাট চালু করা উচিত। যেন কর-সংক্রান্ত সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত হয়। অন্যরা যদি একাধিক ভ্যাট হার চালুর মাধ্যমে ব্যাড প্র্যাকটিস করে, তাহলে আমাদের তা করা ঠিক হবে না। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিস করা উচিত। পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে, আর পেছানো ঠিক হবে না। বাস্তবায়নের স্বার্থে যদি কিছু ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হার থেকে সাময়িকভাবে সরে এসে হলেও অভিন্ন হারে ভ্যাট চালু করা উচিত।
প্রশ্ন: চলতি অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হিসাব কতটা গ্রহণযোগ্য?
জাহিদ হোসেন: প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা সংখ্যা নিয়ে। এটি অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে বিতর্ক নয়। অর্থনীতিতে একটি সন্তোষজনক গতি আছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই সন্তোষজনক। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো; কিন্তু প্রবৃদ্ধির সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যে হিসাব দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিবিএসের সাময়িক হিসাবে, সরকারের বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু মূল বাজেটে সরকারের মূলধন ব্যয় (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ) বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার মতো। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঋণ বাদ দিলে এবং সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ব্যয় যোগ করলে সরকারের মূলধন ব্যয় দাঁড়ায় ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এখানে পার্থক্য ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির দশমিক ৮ শতাংশের মতো। আবার জোগানের দিক বিবেচনা করে জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ বিবিএসের হিসাবে, এই খাতে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলেও পার্থক্য হবে ১১ হাজার কোটি টাকার মতো; যা জিডিপির দশমিক ৬ শতাংশ।
প্রশ্ন: করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। আপনি কি মনে করেন, এটা বৃদ্ধি করা উচিত?
জাহিদ হোসেন: মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এনে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা উচিত। এ জন্য মূল্যস্ফীতির সূচকভিত্তিক স্থায়ী পদ্ধতিতে এই সীমা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে অল্প আয়ের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবেন। আবার ওই সব অল্প আয়ের মানুষের কাছে কর আহরণ করতে গিয়ে খরচেও পোষাবে না। তবে এ বছর যে দাবি করা হচ্ছে, তাতে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার যুক্তি আছে কি না, তা দেখতে হবে। যদি যুক্তি থাকে, তবে করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
প্রশ্ন: করপোরেট কর হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিনিয়োগের স্বার্থে এটা কি করা উচিত?
জাহিদ হোসেন: এ দেশে করপোরেট কর অত্যন্ত বেশি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি ও সিগারেট কোম্পানির ওপর কর সবচেয়ে বেশি। অনেক দিন ধরেই সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না। শোনা যাচ্ছে, শুধু শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হার কমানো হচ্ছে। এটা হলে প্রতীকী সংস্কার হবে। এখন দরকার ব্যাপক সংস্কার। পুরো করপোরেট কর ব্যবস্থায় এই সংস্কার দরকার।
প্রশ্ন: কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কি থাকা উচিত?
জাহিদ হোসেন: এখন এমন নীতি হয়ে গেছে যে ‘যত দিন পর্যন্ত এটা বন্ধের ঘোষণা দেব না, তত দিন কালোটাকা সাদা করা যাবে। এমন সুযোগ থাকলে কেউ কালোটাকা সাদা করায় উৎসাহিত হবেন না। একান্ত বাধ্য না হলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কালোটাকা নিয়ে বসে থাকবেন।
বিনিয়োগ ও কর আদায় বৃদ্ধি-এই দুটি উদ্দেশ্যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বছরের পর বছর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্যই অর্জিত হয়নি। এভাবে দিনের পর দিন এমন সুযোগ দেওয়া হলে এর কার্যকারিতা থাকে না।
প্রশ্ন: গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে দেশ থেকে ৭২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বিনিয়োগের সুযোগ নেই বলেই কি পাচার হচ্ছে?
জাহিদ হোসেন: বিনিয়োগের সুযোগ আছে। কিন্তু বিনিয়োগের পরিবেশের দুর্বলতা আছে। সুযোগ যে আছে এর উদাহরণ হলো, স্যামসাং, অ্যাডিডাস, টাটার মতো শিল্পগোষ্ঠী এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু পরিবেশের দুর্বলতার বিষয়টি বোঝা যায় বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদন দেখে। সেখানে আমাদের খুব বেশি অগ্রগতি নেই। বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকলে বৈধ টাকাও অবৈধ পথে বিদেশে চলে যাবে। আর দুর্নীতির মাধ্যমে যাঁরা অর্থ অর্জন করেন, তাঁরা তো নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে চাইবেনই।
টাকা পাচারের পথগুলো বন্ধ করার মতো মৌলিক জায়গায় হাত দিতে হবে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাজ করছে। এ দেশে বড় সমস্যা হলো দুর্নীতি। সরষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে, তবে সমস্যার সমাধান হবে না। যেমন যাঁরা দুর্নীতি প্রতিরোধ কিংবা টাকা পাচার রোধ করবেন, তাঁরাই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন, তাহলে কোনো কাজ হবে না।
সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো