September 20, 2024 - 5:33 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeকর্পোরেট ভয়েসরাঘব বোয়ালরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি: অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, ইউজিসি , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

রাঘব বোয়ালরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি: অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, ইউজিসি , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

spot_img

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার নতুন বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেক বেশি। রাজস্ব কার্যক্রম অংশে বিভিন্ন কর প্রস্তাবের পাশাপাশি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা নিয়ে কথা উঠেছে। এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। 

প্রশ্ন: এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের ভালো ও মন্দ দিক কী কী?

মইনুল ইসলাম: বর্তমান অর্থমন্ত্রীর আগের সব বাজেটের মতো এবারের বাজেটও রাজস্ব আয়ের দিক থেকে উচ্চাভিলাষী। যে রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটা অর্জিত হবে না বলে মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়। তবে কত কাছাকাছি যাওয়া যায়, সেটিই বিবেচ্য বিষয়। বাজেটে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে ঘাটতি অর্থায়নের যে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা মোটেও নেই। আবার ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সুদের হার বেশি গুনতে হবে। তবে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীলতার ভালো দিক হলো, ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর চাপ পড়ে না।

বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর যেখানে নির্ভরশীলতা বাড়ানোর দরকার ছিল, সেখানে উল্টো সোলার প্যানেলের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। সেচব্যবস্থাকে পুরোপুরি সোলার প্যানেলনির্ভর করার প্রয়াস রাখা উচিত ছিল অর্থমন্ত্রীর। আবার এলপিজি সিলিন্ডারের ওপর প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে মানুষকে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহারে আকৃষ্ট করার আয়োজন রাখা উচিত ছিল। সমুদ্রসীমায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজটি তেমনভাবে এগোচ্ছে না। বাজেটে এতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।

বাজেটে আয়কর সংস্কারের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী অবহেলা করেছেন। কোনো কিছুই তেমন বলেননি। সরকারি রাজস্বের বড় উৎস এখনো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এর পরিবর্তে যদি আয়করের মতো প্রগতিশীল করব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হতো, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝাটা কম পড়ত। এতে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা করব্যবস্থার বোঝাটা আরও একটু গ্রহণ করতে পারতেন। এটা না হওয়ায় প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ছে এটা সত্য, তেমনি আয় ও সম্পদবৈষম্য প্রচণ্ডভাবে বেড়ে চলেছে। এটি নিরসনে প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

প্রশ্ন: নতুন ভ্যাট আইনে এক স্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার নিয়ে ব্যবসায়ীরা আপত্তি জানিয়েছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মইনুল ইসলাম: দেশে ব্যবসায়ী সমাজের হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিতে অস্বচ্ছতা আছে। ভ্যাট তো সাধারণ ভোক্তারা দেন। ব্যবসায়ীরা দেন না। এরপরও এক লাফে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ করায় ব্যবসায়ীরা সোচ্চার হয়েছেন।

ভারতে দুই স্তরে এবং থাইল্যান্ডে চার স্তরে এই ভ্যাট আছে। অনেক পণ্যে অব্যাহতি দেওয়া হলেও এখানে এক লাফে একক স্তর করে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার অনেকখানি বেড়ে যাবে। এর যে অভিঘাত, তা প্রধানত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়াবে। 

আবার ভোক্তা হয়তো ভ্যাট দেবে। ব্যবসায়ীদের হিসাবরক্ষণে অস্বচ্ছতার কারণে এই ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা থেকে যাবে। ইসিআর ব্যবহারের যে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী, তা চালু করতে পারলে অস্বচ্ছতা কমে আসবে। এটি চালু হলে ভ্যাট পরিদর্শকদের সঙ্গে যোগসাজশে ভ্যাটের অর্থ যে ব্যবসায়ীরা মেরে দিচ্ছেন, তা কমবে।

প্রশ্ন: বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মইনুল ইসলাম: বাজেটে টাকার অঙ্কে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়লেও জিডিপির শতাংশ হিসেবে অনেক কম। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বা এ ধরনের মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে মানবপুঁজি গঠনের কার্যক্রমে সরকারি ব্যয় তেমনভাবে বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বরং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের কমতি নেই।

শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির আড়াই শতাংশ বা তার নিচে নেমে গেছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ ইউনেসকো সব দেশকে বলে চলেছে, এটা ৬ শতাংশে নেওয়া দরকার।

ভারতে এটি ৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। ভারত যেখানে ৪ শতাংশ শিক্ষার পেছনের ব্যয় করছে, আমরা সেখানে আড়াই শতাংশ বা তার কম ব্যয় করছি। অথচ আমরা বলে আসছি, এটা শিক্ষাবান্ধব সরকার। এটা একধরনের প্রতারণা।

শিক্ষার মানের অবনমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ভালো করতে পারবে না। বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ প্রবাসী হিসেবে বিদেশে কর্মরত আছে। সেখানে ৯৫ শতাংশ অন্তত অদক্ষ ও অল্পশিক্ষিত মানুষ। শিক্ষার মান বাড়ালে সেখানে দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমশক্তি পাঠাতে পারতাম, তাহলে একদিকে প্রবাসী আয় বাড়ত; অন্যদিকে জনসম্পদের মানের প্রশ্নও থাকত না।

প্রশ্ন: ব্যাংকে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এতে কী প্রভাব পড়বে?

মইনুল ইসলাম: আবগারি শুল্ক আগেও ছিল। এবার অনেক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে আমানতের ওপর সুদের হার ৫ শতাংশে নেমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে সুদের হার যখন কম হয়, তখন আসল সুদের হার শূন্য বা তার নিচে নেমে যায়। এ হিসাবে বাংলাদেশে এখন আসল সুদের হার নেগেটিভ। এর ওপর যদি আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়, ব্যাংকে আমানত রাখাটা একধরনের অপরাধ হয়ে যাবে। সেখানে গেলে মূলধনের ওপর হাত পড়ছে। আমানতই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। এটা অপ্রয়োজনীয় একটা পদক্ষেপ। এ থেকে সরকারের খুব বেশি রাজস্ব আসবে না।

প্রশ্ন: সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য আবার বরাদ্দ দেওয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু?

মইনুল ইসলাম: প্রতিবছর মূলধন জোগাতে বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এটা ভুল পদ্ধতি। এই ব্যাংকগুলো দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত। খেলাপি ঋণ দিন দিন বাড়ছে। অনেক আগেই মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। যদিও ব্যাংকাররাও নানাভাবে এই সমস্যাটাকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। মন্দ ঋণ অবলোপন করা হলেও সেটা একেবারেই আদায় হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এখানে রাঘববোয়ালরা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপ করছে। এই পুঁজিটা দেশের বাইরে নানাভাবে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। আর্থিক খাতে এই সংকটের সমাধান করার কোনো ব্যবস্থা পেলাম না। বরং রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো। এভাবে ব্যাংকিং খাতের সুস্বাস্থ্য ফেরানো কঠিন হয়ে যাবে।

১৯৯৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচারে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রতিটি ব্যাংকের সেরা ১০ ঋণখেলাপির জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের ব্যবস্থা করার। কারণ, অর্থঋণ আদালতে গিয়েও খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ট্রাইব্যুনালে বিচারে শাস্তি পেলে ঋণখেলাপিরা যদি জেল খাটত এবং তাদের সম্পত্তিগুলো ক্রোক হতো, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণের সমস্যা অনেকখানি কমে আসত।

প্রশ্ন: সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে সংকট বাড়লেও বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মইনুল ইসলাম: বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন সত্যিকারভাবে ফরজ হয়ে গেছে। এখন কোনো গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শুরু হলেও সত্যিকার অর্থে ব্যবহারযোগ্য করতে চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। অথচ আমরা দেরি করছি। এই বিলম্ব দেশের অর্থনীতিকে ভোগাবে। বন্দরসুবিধার অভাবে আমদানি এবং রপ্তানি খরচ বেশি হবে।

সমুদ্রবন্দর স্থাপনের গুরুত্ব থাকলেও এবারের বাজেটে সোনাদিয়া সম্পর্কে কোনো কথা নেই। চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও ভারতের ভেটোর কারণে সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দর স্থাপন করতে পারিনি। ভারত ভূরাজনৈতিক স্বার্থে চীনকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দিতে চায় না। সেটা তাদের দিক থেকে ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশ কেন তার শিকার হবে।

সৌজন্যে: প্রথম আলো। 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ