সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। কাছাকাছি সময়ে তাঁদের এ সফর ছিল বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সফরের তাৎপর্য নিয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রশ্ন: চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছাল বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমান: চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফর দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণের একটি জানালা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতির চাহিদার পরিপূরকতা সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ পুরো কাজে লাগাতে পারলে আমরা যে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা করছি, তাতে বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে বিশাল বিনিয়োগের পথে যাচ্ছে চীন। এটা কীভাবে দেখছেন?
মোস্তাফিজুর রহমান: চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে সরকারি ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক বিনিয়োগ চুক্তি হয়েছে। বিষয়টি উভয় পক্ষের দিক থেকে দেখা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান চাহিদায় চীনের আগ্রহ আছে—এটা ভালো দিক। এটা বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে স্থানীয় বিনিয়োগ অনুৎসাহিত হচ্ছে; বিদেশি বিনিয়োগ খুব বেশি আসছে না। চীনের বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্য হলো, অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। চীনের বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ আছে। ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ ও ‘সাউদার্ন সিল্ক রোড’—এসব যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে চীন নিজের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে চাইছে। অন্যদিকে অবকাঠামো ঘাটতি কাটিয়ে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে। তাই চীনের আগ্রহ ও আমাদের প্রয়োজনীয়তার সামঞ্জস্য দেখতে পাচ্ছি।
আমরা যদি সড়ক, বন্দর ও বিদ্যুতের মতো বড় অবকাঠামো চীনের সাহায্যে করতে পারি, তবে আমাদের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও সরবরাহ সক্ষমতা বাড়াতে পারব। এতে স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগও আকৃষ্ট করতে পারব।
প্রশ্ন: চীনের অর্থায়নে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাংলাদেশের কতটা আছে?
মোস্তাফিজুর রহমান: বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রশ্ন সব সময়ই থাকে। যেসব মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্প (চীনের অর্থায়নে) বাস্তবায়ন করবে, তাদের এত কম সময়ে এত বড় বিনিয়োগ বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা লাগবে। দেশের স্বার্থে ঋণের সুদের হার, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা, প্রকল্পের কাঁচামাল কোথা থেকে আসবে, প্রযুক্তি হস্তান্তর কীভাবে হবে—এসব বিষয়ে যদি দর-কষাকষি ঠিকমতো করতে পারি, তবে যে ইতিবাচক ফল চাচ্ছি, তা আরও বেশি পাব।
সাশ্রয়ীভাবে, সময়মতো ও সুশাসনের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব বড় অবকাঠামো হলে যেমন প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে, অর্থনীতির সক্ষমতাও বাড়বে। এ ধরনের বড় ঋণের জন্য দায়ভার বাড়লেও তা পরিশোধে সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন: দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। এ ঘাটতি কমানোর কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?
মোস্তাফিজুর রহমান: চীনে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে হলে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে চীনের বাজারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, নিজেদের অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে কিছু কিছু খাতের বিনিয়োগ বিদেশে নিতে চাচ্ছে চীন। সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার আলাপ-আলোচনা চলছে। ওই বিনিয়োগের পণ্যও চীনে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তৃতীয়ত, চীন, ভারতসহ অনেক দেশেই শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা পায় বাংলাদেশ। চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে পণ্য উৎপাদন করে বিনা শুল্কে ওই সব দেশে রপ্তানি করতে পারবে, যা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলবে। চতুর্থত, চীন বঙ্গোপসাগরে একটি দক্ষিণমুখী গেটওয়ে চাচ্ছে। চীন ইউনান, গুয়াংজুর মতো প্রদেশগুলো অনেকটা স্থলপরিবেষ্টিত। এসব প্রদেশ যদি ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিকশিত করতে চায়, তবে তাদের দক্ষিণ দিকে একটি গেটওয়ে লাগবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের প্রতি চীনের আগ্রহ আছে। এসব অবকাঠামো কাজে লাগিয়ে যদি বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার (বিসিআইএম) করিডর কিংবা দক্ষিণের দিকে আরেক রুট করা হয়, তবে এর সুফল পাবে বাংলাদেশ। সামগ্রিকভাবে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই চীনের সঙ্গে নিবিড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে বাংলাদেশ। সূত্র: প্রথম আলো।