বদরুল ইসলাম বাদল: ৫ই ডিসেম্বর শহীদ দৌলত দিবস,এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চকরিয়ার রাজপথে কক্সবাজার জেলার একমাত্র শহীদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদু সত্তারকে বিতাড়িত করে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেয় জেনারেল এরশাদ। তখন থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দিনগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কালো অধ্যায়। রাষ্ট্র ক্ষমতা জবরদখল করার পরেই নিস্কন্টক করার জন্য দমন, পীড়ন, গুম খুনের খেলায় মেতে উঠেছিল স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদ। নয় বছরের তার শাসন সময়টা জুড়েই ছিল তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের। পত্রিকান্তরে প্রকাশ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রায় ৩৭০ জন মানুষের জীবনহানি হয়েছে। নির্যাতনে অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। হরতাল হয়েছিল ১ বছর ৩২৮ দিন। অবরোধ হয়েছিল ৭০ দিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯ বছরে জাতীয় সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
রাজনৈতিক বিশারদদের ভাষায়,” তখন প্রতিটি দিন বিপদজনক ও ভয়ংকর ছিল নেতাকর্মীদের জন্য”। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত চকরিয়াতে ও সামরিক সরকার বিরোধী তীব্র প্রতিরোধ নিয়ে রাস্তায় নামে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। রাজনীতির সে উত্তাল সময়ে ১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ছাত্রলীগের উপজেলা সহসভাপতি দৌলত খান।
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এরশাদকে মানুষ মেনে নিতে পারে নাই। রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয় সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। আন্দোলন দমনে এরশাদ সেনাবাহিনী ও পুলিশ লেলিয়ে একের পর এক মানুষ হত্যার মাধ্যমে রক্তেরঞ্জিত করে তার ক্ষমতার মসনদ। ১৯৮৭ সালে ১০ নভেম্বর অবরোধ চলাকালীন বুকেপিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখে মিশিলে শামিল হয় যুবলীগ নেতা নুর হোসেন। এরশাদের পেটোয়া বাহিনী তাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা দাবানলের মতো দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশ।
বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বেপরোয়া এরশাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে। ১৯৮৭ সালের ৫ ডিসেম্বর সকালে চকরিয়ার রাজপথ থেকে বিনা উস্কানিতে কয়েকজন আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তখনই বন্দীদের মুক্তির দাবীতে মিশিল করে আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা। মিশিল নিয়ে উপজেলা চত্বরে গিয়ে ছাত্রজনতাদের সামনে বক্তৃতা করছিলেন সেসময়কার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (প্রয়াত) এডভোকেট আমজাদ হোসেন। তখন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে বলার সাথে সাথেই কিছু বুঝে উঠার আগেই বিনা উস্কানিতে এসআই রমানাথ পোদ্দার গুলি ছুটে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে বুক চেপে পড়ে যায় দৌলত খান। সেখান থেকে আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে অতিরিক্ত রক্ত করণের ফলে হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সে দিনের গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আমজাদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা মাষ্টার আবুল হাসেম বি কম, ছাত্রলীগ নেতা আমিনুল রশিদ দুলাল, ইয়াহিয়া খান, খালেদুল ইসলাম, ছাত্র দলের মোহাম্মদ জকরিয়া এবং সেলিম রেজা প্রমুখ।সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের অক্টোবরে জেহাদ, ২৭শে নভেম্বর ডাঃ মিলন হত্যার প্রতিবাদে জনবিস্ফোরণ গণভ্যূত্থানে পরিণত হওয়ায় ১৯৯০ সালের ৬ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
নব্বই দশকের গণআন্দোলন জাতিয় মুক্তির অনুপ্রেরণার ঐতিহাসিক ছবক। মজিদ খানের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের নিজস্ব দাবীতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে গণআন্দোলনে পরিণত হয়। নব্বইয়ের ছাত্রনেতাদের অভিমত, “স্বৈরশাসক হটিয়ে সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা, অবৈধ সামরিক শাসনের চির অবসান, গনতান্ত্রিক মুল্যবোধ ও মৌলিক অধিকার আদায়, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করাই ছিল আন্দোলনের মুল লক্ষ্য”। দুর্ভাগা বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন ভূখণ্ড।যেখানে থাকবে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য আবাস ভুমি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও বাঙালীদের গৌরবের অংশগ্রহণ ছিল।পাকিস্তান শাসনামলে ও বৈষম্যের স্বীকার হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতা বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাদের এদেশীয় এজেন্টরা। পরিণামে হাজার বছরের বাঙালী জাতির ভাগ্যের চাকা দিক পরিবর্তন হয়ে উল্টো পথে হাঁটা শুরু হয়। ক্ষমতা নিয়ে জেনারেল জিয়া মুক্তিযোদ্ধার ছদ্ধাবরণে স্বাধীনতার সমস্ত অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ইতিহাস বিকৃতির মিশন শুরু করে। স্বীকৃত রাজাকার শাহআজিজ গংদের পুনর্বাসন করে। রাজনীতিবিদের হাতে অস্ত্র ও টাকা তুলে দিয়ে চিরাচরিত চরিত্রে কালিমালিপ্ত করে। জেনারেল জিয়া নিহত হওয়ার পর তার একনিষ্ঠ সহযোগী পাকিস্তান ফেরত সেনা অফিসার জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল জিয়ার দেখানো পথে হাঁটতে থাকে। দেশকে অরাজক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায় । যার প্রেক্ষাপটে নব্বইয়ের গণঅভ্যূত্থান ছিল অনিবার্য।নব্বইয়ের পরে ও পরিবর্তিত বেগম জিয়া’র সরকার ঐকমত্যের আন্দোলনকে বৃদ্ধাগুলী দেখিয়ে জামাতকে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে দেশকে অস্থির রাষ্ট্রে পরিণত করে।জাতি দেখতে পায় মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় , রমনা বটমুলে হামলা সহ একই দিনে দেশের প্রতিটি আদালত পাড়ায় হামলা হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ২১ আগষ্ট সন্ত্রাসী হামলার মত কুখ্যাত ঘটনা ঘটে।রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে পড়ে কলুষিত। রাজনীতিতে নীতির চর্চা বিমুখ হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার শাসনামলে ও সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চা থমকে দাড়াঁয়।পচাত্তরের পরবর্তী সরকার রাজনৈতিক কালচার কে ধ্বংস করার যে বীজ ছড়ানো হয়েছিল তা আজকের দিনে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাজনীতির অলিগলিতে। রাজনীতিতে ডুকিয়ে পড়ে সুবিধাবাদ। টাকা ইনকামের ব্যবসা। নেতাদের মাঝে দলের বাইরে নিজস্ব বলয় তৈরী।
এবিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক একছাত্রনেতা বলেন, “এর ফলে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক কর্মীরা পিছিয়ে পড়ে। দলের সুবিধাবাধী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে সামনে চলে আসে। আন্দোলন সংগ্রামে যারা কাজ করে নাই, দলের জন্য কোন ত্যাগ নাই তারাই দলের বড় পদ পদবী নিয়ে মোড়ল সেজে বসে পড়ে”। তৃণমুলদের অভিযোগ তাঁরা হেরে যাচ্ছে টাকার দাপটের কাছে। সুবিধাবাদী মৌসুমী পাখিদের হাতে। তাই বর্তমানের রাজনৈতিক পচনধরা ও রুগ্ন অবস্থা দেখে তৃণমূলের ভাবনা যে,নব্বইয়ের দশকের রাজপথ কাঁপানো সময় গুলো কি শুধু মাত্র সময় এবং শক্তির অপচয় ছিল ? দৌলত খান সহ যারা শহীদ হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে , তাদের চিন্তা কি ভুল ছিল?
আজকাল রাজনীতির চিরচেনা চেতনা যেন মৃতপ্রায়। ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রদের দাবি নিয়ে কেউ এগিয়ে আসে না।দলের সাইনবোর্ডে টেন্ডারবাজী লাইসেন্সবাজী ও দখলবেদখল নিয়ে দলের নেতাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার হয় প্রায় জায়গায়। দিনের পর দিন রাজনীতির এ হাল দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে হতাশা ও বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নেতাদের প্রতি মানুষ আস্তা হারিয়ে ফেলছে। নব্বইয়ের আন্দোলনে এত ব্যাপক নেতাকর্মী ছিল না, নেতাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছিল।সে আস্তা এখন শুন্যের কোটায়। এভাবে রাজনীতিবিদরা যদি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, দেশের স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে, সাধারণ মানুষের অভিযোগ করবার মতো জায়গা থাকবে না, যা হবে নব্বইয়ের চেতনার বিপরীত।
দেশে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কেবল উন্নয়নের মানদণ্ড নয়।বঙ্গবন্ধু মুজিবের ভাষায় “সোনার বাংলা গড়তে হলে মেধাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন রয়েছে। যারা তাদের মেধা অভিজ্ঞতা দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে”।তাই তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলে ফিরিয়ে আনতে পারলে ভবিষ্যতের সমস্ত রাজনৈতিক দুর্যোগে শেখ হাসিনার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দলের পাশে থাকবে। শহীদ দৌলত দিবসে সবারই এই উপলব্ধি জেগে উঠুক।
লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা, সদস্য বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।