নিজস্ব প্রতিবেদক : আসসালামু আলাইকুম। সবার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। কোয়ান্টামের ৩১ তম বছরের শোকরানা সাদাকায়নে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। পরম করুণাময়ের কাছে অনেক শুকরিয়া আজকের সাদাকায়নে এত সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাওয়ার জন্যে। আজকে আলোচনার শুরুতে অভিনন্দন জানাতে চাই তাদেরকে যারা সাদাকায়নের ভেন্যুতে আসার জন্যে পায়ে হেঁটেছেন। যদি মেহেরবানি করে হাত তুলে আমাদের জানান… ধন্যবাদ.. আপনারা খুব ভালো একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন দেহের যত্নায়ন করে। যারা ভোরেই ব্যায়াম করেছিলেন বা মর্নিং ওয়াক করেছেন, তাদেরকেও অভিনন্দন জানাই। হাঁটা ভালো, ব্যায়ামও ভালো। তবে কোনোটি বাদ দিয়ে কোনোটি নয়। কারণ শ্রদ্ধেয়া মা-জী একটি আলোচনায় বলেছিলেন যে, হাঁটা ভালো কিন্তু তা ব্যায়ামের বিকল্প নয়। মানে হাঁটছি বলে ব্যায়াম করতে হবে না তা নয়। বা দৌড়ে দৌড়ে ঘরের কাজ করছি বলে ব্যায়াম বাদ দিলে ব্যায়ামের যে শারীরিক ও মানসিক উপকার রয়েছে, তা থেকে আমরা বঞ্চিত হবো। কারণ দৈহিক শ্রম করলেও দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন-হার্ট, লিভার, কিডনি, অগ্ন্যাশয় ও অন্যান্য এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ডগুলো অর্থাৎ দেহের হরমোন প্রবাহ গতিশীল ও সুষম রাখার জন্যেও প্রয়োজন বিশেষ ব্যায়াম-যেখানে শৃঙ্খলার সাথে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালন হয়। আর দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুস্থ ও গতিশীল রাখতে না পারলে পেশিশক্তি একসময় বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
আসলে গতিশীলতাই সুখ, তাতেই সুস্বাস্থ্য!
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে Happiness is a state of activity-কথাটি বলেছিলেন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল। সচল থাকুন, কর্মব্যস্ত থাকুন। আপনি সুখী হবেন। একুশ শতকে এসেও স্বাস্থ্য-গবেষকরা বলছেন একই কথা। সেটি হলো, সারাদিন কেবল শুয়ে বসে কিংবা বসে থেকে সব কাজ নয়, বরং সুযোগ পেলেই একটু উঠে দাঁড়ান, হাঁটুন, ব্যায়াম করুন। কিছুটা পরিশ্রম আর পেশি সঞ্চালন হতে পারে এমন কাজগুলো করুন আনন্দের সাথে। গতিশীল হোন, যতটা সম্ভব। সুখী হবেন তো বটেই, আপনি সুস্থ থাকবেন। কমবে জটিল সব রোগব্যাধি আর অকালমৃত্যুর ঝুঁকি। সেইসাথে বাড়বে আপনার কর্মময় দীর্ঘজীবনের সম্ভাবনা। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ হাজার মানুষের ওপর ১০ বছর ধরে পরিচালিত একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, যারা তাদের অবসর সময়েও দৈহিক শ্রম ব্যয় করে কোনো না কোনো কাজ করেছেন, তারা অন্যদের চেয়ে বেঁচেছিলেন চার বছরেরও বেশি সময়।
শুধু বড়রা নন, স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা মা-বাবার উদ্দেশ্যে বলেছেন, জন্ম থেকেই শিশুদের হামাগুড়ি এবং শিশুরা হাঁটতে শেখামাত্র দিনে তাদের কমপক্ষে তিন ঘণ্টা শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা, চারদিকে ছোটাছুটি করা, সাঁতার কাটা ও এ জাতীয় শারীরিক কসরতে উৎসাহিত করে তুলতে বলা হয়েছে। কেবল ঘুমের সময়টা ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী সব শিশুকে যতটা সম্ভব কম শুয়ে অথবা বসে থাকার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ শরীরচর্চা না করার ফলে এসব শিশুর স্থূলতা ও মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব ছোটবেলায় এমনকি পাঁচ বছর বয়সের আগে থেকেই যেসব শিশু খেলাধুলা-দৌড়ঝাঁপের মধ্য দিয়ে অধিকতর সক্রিয় থাকতে অভ্যস্ত, তাদের সুষম মনোদৈহিক বিকাশ এবং পরবর্তী জীবনে সুস্থতা ও দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা প্রায়শই উচ্ছল ও কর্মচঞ্চল, একাডেমিক ক্ষেত্রে তাদের ফলাফল তুলনামূলক ভালো। বেশিরভাগ সময়েই এরা জীবনে মেধা ও সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম। অতএব, আমাদের কারো সন্তান যদি অবিরাম চঞ্চলতা আর দুরন্তপনা দেখায় তাহলে শুকরিয়া যেন আদায় করি।
গতি হারিয়ে গেলে সুখ ও সুস্বাস্থ্যও হারিয়ে যেতে পারে!
২০১১ সালে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের উল্লেখযোগ্য সময় যারা টিভি বা কম্পিউটারের সামনে বসে কাটিয়ে দেয়, হৃদরোগে অকালমৃত্যুর হার তাদের অপেক্ষাকৃত বেশি। দিনের পর দিন নিষ্ক্রিয়তা অজান্তেই ঠেলে দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্থূলতা, হাড়ক্ষয়, বয়সজনিত স্মৃতিভ্রষ্টতা ও কয়েক রকমের ক্যান্সারের দিকে। কেন এরকম হচ্ছে?
কারণ বিজ্ঞানের অভাবনীয় সব আবিষ্কার আধুনিক মানুষের জীবনযাত্রাকে করে দিয়েছে অভূতপূর্ব সহজ। দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমাদের পরিশ্রম করার দায় কিংবা সুযোগ কোনোটাই এখন আর প্রায় নেই। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া অবধি আমাদের চারপাশে আজ অসংখ্য বিলাসদ্রব্য; লিফট আর গাড়ির কথা আর নাই-বা বলা হলো। এসির রিমোট, ফ্যানের রিমোট সুইচ, লাইটের বেড সুইচ-এগুলো তো এখন হাতের নাগালেই। এগুলোর কারণে আমাদের চলাফেরা কম করতে হচ্ছে। আগে কলসি করে দূর থেকে পানি আনতে হতো হেঁটে, এখন মটর আছে, ডীপ টিউবওয়েল আছে। বছরের পর বছর ধরে চলা এ পরিশ্রমহীনতা আমাদের সুস্থতাকে ব্যাহত করছে, শারীরিক-মানসিক নানাভাবে। তাই চাই পরিকল্পিত দৈহিক শ্রম, এজন্যে খুব ভালো হচ্ছে হাঁটা এবং ব্যায়াম।
কেন ব্যায়ামকে প্রতিদিনের অভ্যাসে রূপ দেবেন?
পাশ্চাত্যে একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সবধরনের ব্যায়ামের মধ্যে সেরা হলো যোগব্যায়াম। কারণ, মানুষ শুধু দেহেরই অধিকারী নয়, তার রয়েছে একটি সংবেদনশীল মন। আর এই দেহ ও মন জন্মাবধি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। মনের প্রভাব যেমন দেহে পড়ে তেমনি দেহের সুখ-অসুখও প্রভাবিত করে আমাদের মনকে। আর যোগব্যায়াম হচ্ছে একমাত্র ব্যায়াম, যেখানে দেহের সাথে সাথে আমরা আমাদের মনকেও সম্পৃক্ত করতে পারি। যেমন ধরুন, হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার জন্যে রয়েছে কিছু বিশেষ আসন-উজ্জীবন, ভুজঙ্গাসন, অর্ধ-শলভাসন, শলভাসন, পবনমুক্তাসন, গোমুখাসন, উষ্ট্রাসন, বজ্রাসন, শবাসন ইত্যাদি। যখন আপনি এই ব্যায়ামগুলো করবেন তখন অন্যান্য উপকারিতার পাশাপাশি হৃৎপিণ্ড বিশেষভাবে উপকৃত হবে। করোনারি ধমনী প্রসারিত হবে, হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ বাড়বে। ব্যায়ামের সময় যদি আপনি অবলোকন করেন যে, করোনারি ধমনীতে যে ব্লকেজ ছিল তা দূর হয়ে গেছে, সেখানে প্রচুর রক্ত চলাচল করছে, তখন আপনি আপনার মনের শক্তিটাকেও সেখানে যোগ করে দিলেন।
শুধু হৃদরোগ কেন, সার্বিক সুস্থতার জন্যে ব্যায়ামের ভূমিকা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে, শরীর থেকে অতিরিক্ত ওজন ঝরাতে ব্যায়ামের গুরুত্ব বলার অপেক্ষা রাখে না। শরীরকে দৃঢ়, সবল ও পেশির শক্তি বাড়াতে ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। এ-ছাড়াও নিয়মিত ব্যায়ামে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুসংহত হয়ে ওঠে। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনকি দেহকোষের জেনেটিক কোডে-ও সূচিত হতে পারে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন।
শরীরের সুস্থতা তো বটেই, মনের সুস্থতার জন্যেও এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন ও কর্মচঞ্চল থাকেন সবসময়, তাদের ক্ষেত্রে বিষণ্নতার প্রকোপ কম। এদের মানসিক সহিষ্ণুতাও তুলনামূলক বেশি। উপরন্তু, ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে সেরোটনিন ও এন্ডোরফিনের মতো আনন্দবর্ধক নিউরোট্রান্সমিটারের প্রবাহ বাড়ে, দেহ-মন থাকে চনমনে। চিন্তাশক্তি আর বুদ্ধিমত্তা তখন কাজ করে চমৎকার। কানাডার নিউরোলজি এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত নিবন্ধে এটি বলা হয়েছে।
ব্যায়াম মস্তিষ্কের শক্তিও বাড়ায়
দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা প্রতিদিন অথবা নিদেনপক্ষে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করেন তাদের মস্তিষ্কের শক্তি ও কার্যকারিতা বাড়ে, মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে অধিকতর সচল ও কর্মক্ষম। গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, নিয়মিত ব্যায়ামে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ে। মস্তিষ্কের রক্তনালীর সংকোচন প্রতিরোধে সাহায্য করে, মস্তিষ্কের কোষ নিউরোনকে সবল করে, এমনকি নতুন নতুন নিউরোন তৈরিতে সাহায্য করে। আর এ গবেষণা-প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আমাদের বয়স যখন ২০-এর কোঠায় থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের (যা আমাদের শেখার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে) ক্ষমতা ও কার্যকারিতা কমতে থাকে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে। আর ব্যায়াম বয়সজনিত এই ক্ষয়ের গতিটাই কমিয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্যে এক দল ইঁদুরকে কয়েক সপ্তাহ ধরে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখেন এবং অপর দলকে আবদ্ধ স্থানে রাখেন। পরবর্তীতে এদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা যায়, যে দলটি উন্মুক্ত পরিবেশে ইচ্ছেমতো ছোটাছুটির মধ্যে ছিল, তাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে নতুন নিউরোন তৈরি শুরু হয়েছে, কিন্তু অন্য দলের ক্ষেত্রে তা হয় নি।
যোগব্যায়ামের সহজ সংস্করণ হিসেবে কীভাবে এলো কোয়ান্টাম ব্যায়াম?
১৯৮৩ সালে যোগ মেডিটেশন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে প্রথম মহিলাদের ব্যায়াম শেখাতে শুরু করেন শ্রদ্ধেয়া মা-জী। বছরের পর বছর শত শত মহিলা তার কাছ থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যোগাসনের এই প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে একটা সময় শ্রদ্ধেয় গুরুজী ও শ্রদ্ধেয়া মা-জী অনুভব করলেন যে, ব্যস্ত জীবনের প্রেক্ষাপটে একে আরো সহজ করা দরকার। তাহলে আরো বেশি মানুষ এ থেকে উপকৃত হবেন। বছরের পর বছর গবেষণা চলতে থাকে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে। বিভিন্ন আসনে দম নেয়া ও ছাড়া নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে চর্চাকারীরা এক ধরনের বিভ্রান্তি ও জটিলতার সম্মুখীন হতেন। এ বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির জন্যে দম স্বাভাবিক রেখে আসনের চর্চা করে দেখা যায় একই উপকার চমৎকারভাবে পাওয়া যাচ্ছে। আর এরপর আসনের সাথে যুক্ত করা হলো কোয়ান্টাম মেথড চর্চার আলোকে সুস্থতার মনছবি। উদ্ভাবিত হলো যোগের সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ আধুনিকায়ন-কোয়ান্টাম ব্যায়াম।
এজন্যেই সবাইকে অনুরোধ করব যেন ব্যায়াম করলে কোয়ান্টাম ব্যায়াম করি। কোয়ান্টাম ব্যায়াম আধুনিক মানুষের জন্যে উপযোগী করে সহজভাবে করা হয়েছে। (সম্মানিত বাণীবাহক, এ পর্যায়ে রোগ নিরাময়ে কোয়ান্টাম ব্যায়াম ও সৌন্দর্যচর্চা বইটি দেখিয়ে মেহেরবানি করে বলুন। বইটি এজন্যেই দেখানোর অনুরোধ করছি যাতে যাদের সংগ্রহে নেই তারা আগ্রহী হতে পারেন কিংবা অন্তত নতুন কেউ জানতে পারেন যে, এ সংক্রান্ত একটি চমৎকার বই ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে)। আমরা অনেকেই জানি যে, শ্রদ্ধেয়া মা-জী খুব সহজসরল ভাষায় এ বইটি লিখেছেন। মা-জীর দুই যুগের দীর্ঘ গবেষণা, শ্রম ও ধৈর্যের ফসল আসলে এ বইটি। শ্রদ্ধেয় গুরুজী এর ভূমিকায় লিখেছেন যে, (সম্মানিত বাণীবাহক, এ অংশটুকু বইটি দেখে পড়তে পারেন) এত নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস যোগব্যায়াম চর্চাকারিণী আমি দেখি নি। (শ্রদ্ধেয় গুরুজীর) সহধর্মিণী হিসেবে ঘরে আসার পর আমার যোগ ধ্যানচর্চা তার মনে স্বাভাবিক কৌতূহল সৃষ্টি করে। আসনের উপকারিতা বোঝার পর চর্চার কথা আর বলতে হয় নি। আসন, মুদ্রা ও প্রাণায়াম চর্চায় আমরা হয়ে উঠি একাত্ম।
কোয়ান্টাম ব্যায়াম : করলে উপকার, কিন্তু না করলে ক্ষতি একটাই যে উপকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে
দীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যন্ত্রনির্ভর ভারী ব্যায়াম বা শরীরকে পেশিবহুল করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়ার প্রত্যাশায় করা অন্যান্য ব্যায়ামের চেয়ে যোগচর্চা সুস্থতার জন্যে বেশি কার্যকর। ভারী ও পেশিবহুল শরীর তৈরি করতে গিয়ে ব্যক্তির আবেগের ভারসাম্যহীনতা, পেশির স্বতঃস্ফূর্ততা হ্রাস এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। আর যোগচর্চায় পেশি মজবুত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গের স্বতঃস্ফূর্ততা বাড়ে। কোলেস্টেরলের পরিমাণ, ওজন ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে আসে। কারণ যোগচর্চা এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনের পরিমাণ সুষম করে।
অন্তত একটি আসন হলেও প্রতিদিন করুন :
আমরা যারা সারাদিন খুব কর্মব্যস্ত থাকি, আমাদের পক্ষে ব্যয়ামের জন্যে আলাদা সময় বের করা মুশকিল। তো দৈনন্দিন জীবনে এমন কি কিছু আছে যা কাজের মাঝে, ব্যস্ততার মাঝেও আমরা করতে পারি। এবং সুস্থ থাকতে পারি।
প্রথমত, সুস্থ থাকতে হলে আপনাকে নিজের জন্যে সময় করে নিতেই হবে। কারণ আজ ব্যস্ততার কথা বলছেন। নিজের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না। যখন অসুস্থ হবেন ব্যস্ততা মাথায় উঠবে! সমস্ত মনোযোগ তখন দিতে হবে নিজের প্রতি, শরীরের প্রতি। কিন্তু হয়তো দেখা যাবে সমস্ত মনোযোগ, সমস্ত সঞ্চয়, সমস্ত যত্ন ঢেলে দিয়েও আর সুস্থতা ফেরানো যাচ্ছে না। আপনি অসুস্থ মানুষদের দিকে তাকান। দেখবেন এই বাস্তবতাই।
কাজেই যত ব্যস্ত থাকেন, এর মধ্যেই কীভাবে ব্যায়াম, মেডিটেশন, প্রাণায়ামসহ যত্নায়নের অন্যান্য জিনিসগুলো করা যায় সেই চেষ্টা করুন। আর দৈনন্দিন জীবনে একটি চর্চার কথা যদি জানতে চান তাহলে বলতে পারি একটি আসনের কথা। যোগে এটাকে মলাসন বা উৎকটাসন (বিশ্রাম অবস্থা) বলা হয়। কিন্তু আমরা এর নতুন নামকরণ করেছি বঙ্গাসন। কারণ যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা এভাবে বসে শুধু যে মলত্যাগ করতেন তা না, বসতেন, অপেক্ষা করতেন, কথা বলতেন। সবকিছু করতেন। কিন্তু সভ্য হতে গিয়ে আমরা মলত্যাগের জন্যে হাই কমোডের ব্যবস্থা করলাম। মাটিতে বসার বদলে চেয়ারে বা সোফায় বসা অভ্যেস করলাম। সেইসাথে হারাতে শুরু করলাম আমাদের সুস্থতা।
আসলে বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন-আধুনিক মানুষের যেসব রোগব্যাধি হয়, মৃত্যু হয় তার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হলো চেয়ারে বসা। আরাম কেদারায় বসা, সোফায় বসা। যে কারণে এখন বলা হয় সিটিং ইজ নেক্সট স্মোকিং। বা রিভলবিং চেয়ার বা সোফাকে বলা হয় কিলার চেয়ার বা খুনি চেয়ার। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষদের কিন্তু এত রোগবালাই ছিল না। কেন? তারা এই বঙ্গাসনে বসতেন। বঙ্গাসন কেমন? [যারা প্রথমবারের মতো বঙ্গাসন নিয়ে শুনছেন তাদের জন্যে বলা] স্কোয়াট বা লো কমোডে মানুষ যেভাবে বসে, সেভাবে। ভর থাকবে পায়ের গোড়ালিতে। দুই পায়ের মধ্যে ফাঁকা থাকবে এবং হাত দুটো পায়ের দুই হাঁটু ঘিরে থাকবে। শরীরের ভর ছেড়ে দিতে হবে। অনেক সময় দেখবেন ভোরবেলা রাস্তার ধারে দিনমজুররা কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় যেভাবে বসে থাকে।
বলবেন যে কী হবে এই আসন করলে। আসলে শরীরকে ফিট রাখতে এই আসনটির এত উপকার বলা হয় যে আপনি যদি নিয়মিত বঙ্গাসন করতে পারেন তো আপনার আয়ু বেড়ে যাবে। কারণ আপনার ফিটনেস বেড়ে যাবে। হজম এবং রেচনের জন্যে দারুণ। কারণ মলত্যাগের সময় বঙ্গাসনে বসলে রেচনের অঙ্গগুলো যে ভঙ্গিতে থাকে তা খুবই উপকারি (আসলে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের দেহটা সৃষ্টি এভাবে রেচনক্রিয়ার জন্যে)! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহিলারা যারা নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে চান তাদের জন্যে আদর্শ হলো বঙ্গাসন। মানে কোনো তরুণী যদি নিয়মিত বঙ্গাসন করেন তাহলে মা হবার সময় তার নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটা আমাদের কথা না, গবেষণালব্ধ তথ্য। দেখা গেছে যারা বঙ্গাসন করতে পারেন এমন মায়েদের ২০ থেকে ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে বেশি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। এজন্যে নিয়মিত এটা চর্চা করতে পারেন। প্রথমেই বেশি সময় হয়তো পারবেন না। একটু একটু করে বাড়ান। প্রথমে ২০ সেকেন্ডে, তারপর ৪০ সেকেন্ড, আস্তে আস্তে ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৩ মিনিট। যদি সম্ভব হয় তাহলে যে-কোনো কাজের পরিবেশকেও এমন করে নিন যাতে বঙ্গাসনে বসে করতে পারেন। আর দিনে অন্তত ১৫ মিনিট বঙ্গাসন, বজ্রাসন, দন্ডাসন করুন পর্যায়ক্রমে। আপনি অনেক ঝরঝরে অনুভব করবেন।
এক কলেজছাত্র বলছিলেন যে, বর্তমানে তিনি প্রায় ৩০ মিনিট বঙ্গাসন চর্চা করতে পারেন। এবং অনেক রকম কাজ যেমন পত্রিকা পড়া বা বই পড়া এ কাজগুলো বঙ্গাসনে বসে করার কারণে তার একসাথে দুইটা উপকার হচ্ছে-তার সময় সাশ্রয় হচ্ছে, আর এই ব্যায়ামের ফলে তার শারীরিক অনেক রকম উপকারও হয়েছে। যেমন তার পায়ের পেশি আগের চেয়ে অনেক সবল হয়েছে। আগে অনেক দূর হাঁটাহাটি করলে তার হাঁটুতে একটু ব্যথা করত। এখন সেটা দূর হয়েছে। এখন তিনি অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারেন। তার মেরুদণ্ড আগের থেকে অনেক নমনীয় এবং কমনীয় হয়েছে। আরেক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বলছিলেন যে, খাদ্যাভ্যাস ও বঙ্গাসন অনুশীলনে তার একমাসে ওজন কমেছে তিন কেজি। একজন চিকিৎসক বঙ্গাসন নিয়ে তার অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে শেয়ার করেছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন আমি হুবহু পড়ে শোনাচ্ছি-প্রতিদিন আমাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে বা আমাদের অফিসিয়াল্ভাবে যত রোগী আছে প্রায় ৭০ ভাগই বিভিন্ন ধরনের ব্যথা নিয়ে আসে। বিশেষ করে মাজা, হাঁটু এবং গোড়ালিতে। তো এরকম অনেক রোগী আছে যারা হয়তো ডাক্তার অপারেশন করেছেন হাঁটুতে। নি ক্যাপ ব্যবহার করতে হতো। নি ক্যাপ ছাড়া চলতেই পারত না। এরকম রোগীরাও চেম্বারে আসে। তো এরকম একজন রোগীকে আমি ওষুধের পাশাপাশি বঙ্গাসন করার জন্যে অনুরোধ করি। সে প্রায় একমাস বঙ্গাসন করার পরে তার আর নি ক্যাপ ব্যবহার করতে হচ্ছে না। সে এখন নি ক্যাপ ছাড়াই হাঁটতে পারছে।
এছাড়া যত বয়স্ক রোগী এবং মধ্য বয়স্ক রোগী মাজা এবং কোমরে ব্যথা নিয়ে আসেন হাঁটুর ব্যথা নিয়ে আসেন তাদেরকে অন্যান্য ডাক্তাররা বলে দেয় যে আপনি চেয়ারে বসবেন। রুকু সেজদা দিয়ে নামাজ পড়বেন না। ভারী কাজ করবেন না। আমি সাধারণত বলে থাকি আপনারা সব কাজগুলো স্বাভাবিকভাবে করবেন এবং নিয়মিত বঙ্গাসন চর্চা করবেন। তো এরকম অনেক রোগী আছেন যারা প্রথম দিকে আসলে সাধারণত বসতেও তাদের কষ্ট হতো। তারা ১৫ দিন বঙ্গাসন করার পরে স্বাভাবিকভাবে বসতে পারছেন এবং তাদের মাজা, কোমর এবং গোড়ালির ব্যথা দূর হয়ে যায়। এভাবে আমার প্রতিদিন যত রোগী আসে তাদেরকে আমি এই বঙ্গাসন করার জন্যে অনুরোধ করি। সাথে আমাদের কোয়ান্টামের যে বুলেটিন আছে বঙ্গাসনের ওপর সে বুলেটিন তাদেরকে দিয়ে বলি এটা আপনি সাথে নিয়ে যান এটাকে একটা ব্যায়ামের বই হিসেবে আপনি ব্যবহার করবেন। নিয়মিত নিজে চর্চা করবেন। অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করবেন। তাহলে আপনি ব্যথামুক্ত থাকবেন। দীর্ঘজীবন লাভ করবেন। অনেককে এই বুলেটিন আমার চেম্বারে দিচ্ছি। সবাই ভালো উপকার পাচ্ছে। আশা করি বঙ্গাসন করার কারণে অনেকেই তাদের মাজা, কোমর এবং গোড়ালির ব্যথা থেকে মুক্ত থাকছেন। এবং তারা ওষুধ ছাড়া অনেকটা ভালো থাকছেন।
তবে বঙ্গাসন বলুন বা অন্য কোনো আসন বলুন-করতে গিয়ে মনে রাখতে হবে-কোনো আসন প্রথমবারেই সঠিক ভঙ্গিমায় জোর করে করার চেষ্টা করবেন না। সহজভাবে যতটুকু পারেন, ততটুকুই করুন। ধীরে ধীরে শরীর নমনীয় হয়ে উঠলে ভঙ্গিমাও ঠিক হয়ে যাবে। তা না হলে হঠাৎ করে শরীরের কোনো জায়গায় টান পড়তে পারে কিংবা মেরুদণ্ডে, ঘাড়ে, কোমরে টান লেগে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রতিটি আসন করতে গিয়ে অতিরিক্ত জোর না খাটিয়ে বরং আপনি যতটুকু পারছেন, ততটুকুই করুন। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে করতে পারলে। এজন্যে কোয়ান্টাম ইয়োগা ওরিয়েন্টেশন আছে। দুদিনের প্রোগ্রাম। করতে পারেন। সেন্টার, শাখা, সেলে যেখানে সাপ্তাহিক ইয়োগা সেশন হয়, সেখানে আসতে পারেন। যত সঙ্ঘবদ্ধভাবে করবেন, তত আনন্দে করতে পারবেন। তখন ব্যক্তিগতভাবে করতেও ভালো লাগবে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে করতে অনেক সময় আলসেমি, দীর্ঘসূত্রিতা কাজ করতে পারে। সঙ্ঘবদ্ধভাবে করতে করতে একটা ভালোলাগা তৈরি হয়, সুঅভ্যাস তৈরি হয়। আসলে যত সুস্থ থাকব, তত আমরা ব্যস্ত হতে পারব। আর শরীর ও মনের সুস্থতার জন্যে মেডিটেশন এবং কোয়ান্টাম ইয়োগার ভূমিকা এখন নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই আসুন প্রতিদিন কোয়ান্টাম ইয়োগা ও দমচর্চা করি। ভালো থাকি, সুস্থ থাকি।