একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কোম্পানি সচিব এবং করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান নেয়ামুল হক এসিএস।
নেয়ামুল হক এসিএস ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কোম্পানি সচিব এবং করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজে এমবিএ সম্পন্ন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। চাকরির পাশাপাশি পেশাগত ডিগ্রি এলএলবি ও চার্টার্ড সেক্রেটারি সম্পন্ন করেছেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) একজন সহযোগী সদস্য
প্রশ্ন: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।
নেয়ামুল হক: ২০০৮ সালে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেডে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। ২০১৪ সালের শেষ দিকে ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডে সহকারী কোম্পানি সচিব হিসেবে যোগদান করি। জুলাই ২০১৬ থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছি।
প্রশ্ন: পেশা হিসেবে কোম্পানি সচিবকে কেন বেছে নিলেন?
নেয়ামুল হক: কোম্পানি সচিব পেশায় ক্যারিয়ার গড়বো, এমন পরিকল্পনা ছিল না। ২০১১ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রথম চার্টার্ড সেক্রেটারি কোর্স সম্পর্কে জেনে বেশ আগ্রহী হই। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ভর্তি হয়ে যাই। ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের কাছ থেকে এ পেশার পেশাগত চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরে কোম্পানি সচিবের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার অনুপ্রেরণা পাই।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজন সচিবের সম্পর্ক কেমন?
নেয়ামুল হক: কোম্পানি সচিব একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করেন। এজন্য সচিবকে অনেক সময় সেতুবন্ধনকারী বলা হয়। কোম্পানি সচিব মূলত শেয়ারহোল্ডার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেতুর বন্ধনের কাজটি করে থাকেন। এছাড়া ব্যাবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের মাঝেও প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বিধিবদ্ধ আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিশ্চিতকরণ ও স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন কোম্পানি সচিব।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে সচিবের ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাই।
নেয়ামুল হক: বর্তমান সময়ে কোম্পানি সচিব পদটি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বিদ্যমান কোম্পানি আইন, সিকিউরিটিজ আইনসহ অন্যসব আইন সঠিকভাবে মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করেন কোম্পানি সচিব। একইসঙ্গে তিনি একজন স্ট্যাটিউটরি অফিসার, এমনকি পরিচালনা পর্ষদের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরিচালনা পর্ষদের গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত আইন পরিপন্থি হলে কোম্পানি সচিব পরিচালনা পর্ষদকে সে সম্পর্কে অবহিত করেন। কোম্পানি সচিব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কমপ্লায়েন্স অফিসার, যিনি প্রতিষ্ঠানিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। শেয়ারহোল্ডাররা একমাত্র সচিবের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানি সচিবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে সব তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব পদটি বাধ্যতামূলক করেছে।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিবের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?
নেয়ামুল হক: কোম্পানি সচিবের দায়িত্ব কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডি বা ডিপার্টমেন্টের মাঝে সীমিত নয়। প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে তাকে কাজ করতে হয়। সব বিভাগের কাজ ও কার্যপদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় কোম্পানি সচিবকে তার কার্য সম্পাদনে অনেক বেশি কৌশলী হতে হয়। তাছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ, ম্যানেজমেন্ট, শেয়ারহোল্ডার প্রভৃতি পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের যেকোনো তাৎক্ষণিক ও সর্বশেষ তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোম্পানি সচিবকে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে হয়, যা খুবই চ্যালেঞ্জিং। তবে এর মধ্য দিয়েই একজন কোম্পানি সচিবের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: কর্মক্ষেত্রে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে আপনার মূলমন্ত্র কী?
নেয়ামুল হক: প্রথমে যে বিষয়টি আসে তা হলো গুরুত্বসহ অন্যের কথা শোনা, তারপর সমাধানের চেষ্টা করা। অন্যের ভুলভ্রান্তি এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত, যেন তিনি অসন্তুষ্ট না হন। এক্ষেত্রে পেশাগত আচরণে পারদর্শী ও মুক্তমনের অধিকারী হতে হয় কোম্পানি সচিবকে।
প্রশ্ন: একই সঙ্গে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক ও কোম্পানি সচিব পেশাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
নেয়ামুল হক: বিষয়টি আমার জন্য বেশ উপভোগ্য। একই সঙ্গে কোম্পানি সচিব ও একটি বিভাগীয় প্রধানের পদে থাকায় নীতিনির্ধারণে মতবিরোধ ও সময়ক্ষেপণ বিষয়টি এড়ানো যায়। তাছাড়া কোম্পানির সাচিবিক ও মানবসম্পদÑউভয় বিভাগের কাজ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। তাই যেকোনো কোম্পানির সাচিবিক বিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
নেয়ামুল হক: যারা এ পেশায় আসতে ইচ্ছুক, তাদের স্বাগত জানাই। পেশাটি নিশ্চিতভাবে তাদের ক্যারিয়ারকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। বিদ্যমান কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর রিফর্ম হতে যাচ্ছে। ফলে এ পেশার পরিধি ও সুযোগ ক্রমেই বাড়বে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে এরই মধ্যে কোম্পানি সচিবের গুরুত্ব সর্বজনস্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। তাই বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতেও কাজের সুযোগ রয়েছে। যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন, পরিশ্রম করার মানসিকতা রাখেন, তাদের জন্য এ পেশা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।
প্রশ্ন: সফল কোম্পানি সচিব হতে হলে আপনার পরামর্শ কী?
নেয়ামুল হক: প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগতসহ যেকোনো পর্যায়ে যোগাযোগে দক্ষ হতে হবে, পরিশ্রমী হতে হবে। সময়ের সঙ্গে নিজেকে আপডেট রাখতে হবে ও সব সময় জ্ঞান অর্জনের মধ্যে থাকতে হবে। আর নৈতিকতার ব্যাপারটিতে আপসহীন হতে হবে, কেননা সততার কোনো বিকল্প নেই।
সৌজন্যে: দৈনিক শেয়ার বিজ।