September 20, 2024 - 2:40 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeকর্পোরেট ভয়েসমোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

spot_img

সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এদেশের মানুষে বহু পুরনো প্রত্যাশা। সে আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাদেশের কক্সবাজার, যশোরসহ একাধিক এলাকায় সুদমুক্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রচেষ্টার কথা জানা যায়। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতে সে সব উদ্যোগ স্থায়ী ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। মুসলিম বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিং আন্দোলন শক্তিশালী হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকালে।

১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক বা আইডিবির চার্টার স্বাক্ষর করে এবং নিজ দেশে ইসলামি শরিয়ার ভিত্তিতে ১৯৭৬ সালে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তানায়ক মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীমের নেতৃত্বে ঢাকায় ইসলামিক ইকনোমিকস রিসার্চ ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন বাংলাদেশে ইসলামি অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ ও ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে।

১৯৭৮ সারের এপ্রিল মাসে সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত ইসলামিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে ইসলামি ব্যাংকের সংজ্ঞা অনুমোদন করা হয়। বাংলাদেশ এ সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে এ সুপারিশ অনুমোদন করে।

১৯৭৯ সালে নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মহসিন দুবাই ইসলামি ব্যাংকের অনুরূপ বাংলাদেশে একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে সুপারিশ করেন। এর পরপরই ডিসেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং উইং বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিমত জানতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসান ১৯৮০ সালে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য দুবাই ইসলামি ব্যাংক, মিসরের ফয়সল ইসলামি ব্যাংক, নাসের সোশ্যাল ব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইসলামিক ব্যাংকসের কায়রো অফিস পরিদর্শন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন।

১৯৮০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসভূক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শামসুল হক সদস্য দেশগুলোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

১৯৮০ সালের ১৫-১৭ ডিসেম্বর ইসলামিক ইকনোমিকস রিসার্চ ব্যুরোর উদ্যোগে ঢাকায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর নূরুল ইসলাম ওই সেমিনার উদ্বোধন করেন। তিনি তার ভাষণে বাংলাদেশে একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

বায়তুশ শরফের মরহুম পীর হযরত মাওলানা আবদুল জববার (রাহ.) এর সভাপতিত্বে ১৯৮১ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলনায়তনে সুদ বিহীন ইসলামী ব্যাংক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহীম প্রধান অতিথি হিসেবে সেমিনারে যোগদান করেন। অংশগ্রহণকারীগণ বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জোর দাবী উত্থাপান করেন।

১৯৮১ সালের মার্চে ওআইসিভূক্ত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সম্মেলন সুদানের খার্তুমে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পেশকৃত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান, বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।

১৯৮১ সালে এপ্রিল মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লেখা এক পত্রে পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শাখাগুলোতেও পরীক্ষামূলকভাবে পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং কাউন্টার চালু করে এ জন্য পৃথক লেজার রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।

১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ওপর এক মাস স্থায়ী সার্বক্ষণিক আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। এ কোর্সে বাংলাদেশ ব্যাংক, সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিআইবিএম ও প্রস্তাবিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড (বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড)-এর ৩৭ কর্মকর্তা অংশ নেন। সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল এম আযীযুল হক এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮২ সালে ২৮ জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) উদ্যোগে ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়।

হিজরী চৌদ্দ শতকের সূচনালগ্নে মহরম মাসের ১ তারিখে (২২ নভেম্বর ১৯৭৯) বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আলহাজ্ব এম খালেদের নেতৃত্বে ঢাকায় বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবা) কাজ শুরু করে। এর আগে সোনালী ব্যাংক স্টাফ ট্রেনিং কলেজে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যাংকারদের অনেক বিবার কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৮২ সালে এ সংগঠন ব্যাংকার, আইনজীবি, সাংবাদিক, বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন স্তরের লোকদের জন্য পাঁচটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করে।

১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তারা বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে যৌথ উদ্যোগে একটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আইডিবির অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করার ব্যাপারে ইসলামিক ইকনোমিক্স রিসার্চ ব্যুরো (আইইআরবি) এবং বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবা) অগ্রণী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিতব্য ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য দক্ষ ব্যাংকারের শূন্যতা পূরণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদকে ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এছাড়া এদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পক্ষে জনমত গঠন ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তারা সেমিনার সিম্পোজিয়াম এবং ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। মুসলিম বিজনেসমেন অ্যাসোসিয়েশন (বর্তমানে মুসলিম ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টস অ্যান্ড বিজনেসমেন অ্যাসোসিয়েশন) ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোক্তা মূলধন সংগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

বহুমাত্রিক চেষ্টার ফসলরূপে ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এক্ষেত্রে ১৯জন বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব, ৪টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এবং আইডিবিসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা এবং সৌদি আরবের দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোক্তারূপে এগিয়ে আসেন।

১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড নামে বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকের প্রস্ত্ততিমূলক কাজ করা হয় এবং এ নামেই তখন পর্যন্ত ব্যাংকের সাইনবোর্ড ও প্রচার-পুস্তিকা ব্যবহার করা হয়। আলহাজ্ব মফিজুর রহমান ২৯ মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এরপর এ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকের একটি চমৎকার মনোগ্রাম তৈরি করে দেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার সবিহউল আলম।

১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বুধবার সকাল ৯টায় অনাড়ম্বর পরিবেশে লাইসেন্সের শর্ত পূরণের জন্য ৭৫নং মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ব্যাংকের রেজিস্টার্ড অফিসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়।

ব্যাংকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোনো আনুষ্ঠানিক দাওয়াতপত্র ছাপা হয়নি। শুধু পত্রিকায় খবর দেখে অনেক লোক এ অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অগ্রযাত্রার পথ ধরে পরে এদেশে আরোও কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৭ সালে আল বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক এবং বর্তমানে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ নামে ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এর নাম হয় শামিল ব্যাংক অব বাহরাইন (ইসলামি ব্যাংকার্স) বর্তমানে এদেশে এ ইসলামী ব্যাংকটির কার্যক্রম নেই। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ২০০৪ সালে ১ জুলাই থেকে সুদভিত্তিক এক্সিম ব্যাংক তার কার্যক্রম ইসলামি পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করে। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পরিহার করে ইসলামি পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড নাম ধারণ করে।

উল্লেখিত ৭টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের প্রায় ৬০০ শাখা ছাড়াও ৯টি সুদভিত্তিক ব্যাংকের মোট প্রায় ৩০টি পৃথক ইসলামি ব্যাংকিং শাখা বর্তমানে কাজ করছে।

বিশ শতকের ষাটের দশকের মিসরের মিটগামার থেকে যাত্রা শুরু করে ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থা মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের মধ্যেই তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যকে বিশ্বব্যাপী সুস্পষ্ট করতে এবং সাড়া জাগাতে সমর্থ্য হয়েছে। বাংলাদেশেও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র কাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বেসরকারি পর্যায়ে ইসলামি ধাঁচে আর্থিক পুনর্গঠনের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং এখন আর শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়। মুদারাবা, মুশারাকা, বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল, বাই সালাম প্রভৃতি পরিভাষা এখন এ দেশের লাখো মানুষের দৈনন্দিন বাস্তব আর্থিক লেনদেনের ভাষা হিসেবে চালু হয়েছে। তিন দশকের কম সময়ের মধ্যে দেশের সমগ্র ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এখন ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পদ্ধতির আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা বিসৃতত হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বে ইজতিহাদ বা গবেষণার যে ধারাটি স্তিমিত হয়ে পড়েছিল ইসলামি ব্যাংকিং সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। ইসলামি ব্যাংকিংকে কেন্দ্র করে ইজতিহাদ বাংলাদেশেও একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে চলেছে। ইসলামি ব্যাংক ব্যবস্থার এ পরিচালনগত সফলতা সবার সামনে এ বিষয়টি আবার স্পষ্ট করেছে যে, আধুনিক বিশ্বের মানুষ সুদের মতো ক্ষতিকর উপাদান বর্জন করেই তাদের সব কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদন করতে পারেন। এদিক থেকে ইসলামি ব্যাংকিং নতুন আস্থা ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সমর্থ্য হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণের বিপুল সাড়া ও সমর্থন লাভ করেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সার্বিক পরিচালনগত সফলতা এদেশে নতুন ৪টি ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করেছে। কয়েকটি বিদেশি ব্যাংকসহ প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোও ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো খুলতে এগিয়ে এসেছে। দুটি সুদভিত্তিক ব্যাংক ইতিমধ্যে ইসলামি পদ্ধতির ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি ব্যাংক এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।

প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, এবি ব্যাংক লিমিটেড, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও যুমনা ব্যাংক লিমিটেড তাদের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যেই পৃথকভাবে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা খুলেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড এবং বেসরকারী খাতের পূবালী ব্যাংক লিমিটেডসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের উল্লেখযোগ্যসংখক সুদভিত্তিক কনভেনশনাল (প্রচলিত শাখার অভ্যন্তরে ইসলামি ব্যাংকিং ইউন্ডো চালু করেছে।

এসব ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও ইসলামি শরিয়াহ্র নীতিমালা অনুসারে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে। জমা সংগ্রহ ও বিনিয়োগ কার্যক্রমে উল্লিখিত শাখা/ইউন্ডোগুলোর উন্নয়নধারা সন্তোষজনক। জাতীয় সঞ্চয় আহরণে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে ইসলামি ব্যাংকগুলোর সামর্থ্য ও নিট অবদান সুদি ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ইসলামি ব্যাংকগুলোর জমার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে। ইসলামি ব্যাংক কর্তৃক বেশি হারে সঞ্চয় আহরণের ফলে জাতীয় আর্থ-সামাজিক খাতে সুদের নেতিবাচক প্রভাব কমছে এবং ইসলামি ব্যাংকিংয়ের ইতিবাচক অংশীদারিত্ব ক্রমেই বাড়ছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমের দিকে তাকালেও এক্ষেত্রে তাদের সামাজিক লক্ষ্য ও তার অবদান স্পষ্ট হবে। যৌতুকের মতো অপরাধ নির্মূলে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং বিবাহিত পুরুষদের মোহর আদায়ে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ব্যাংকিং জগতে প্রথমবারের মতো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ মুদারাবা মোহর সঞ্চয় হিসাব চালু করেছে। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নে এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকও মুদারাবা বিবাহ সঞ্চয় প্রকল্প চালু করেছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক পৃথক মুদারাবা দেনমোহর সঞ্চয় স্কিমও চালু করেছে।

ওয়াকফ সম্পত্তি এক সময় এদেশের সামগ্রিক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বর্তমানে নিরুৎসাহিত এ ধারাটিকে বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ এবং পরে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিঃ। কর্মব্যস্ত বিত্তশালী ব্যক্তিদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ ও আগ্রহী করা এবং এ কাজে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়ার জন্য উদাহরণস্বরূপ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মুদারাবা ক্যাশ ওয়াক্ফ ডিপোজিট স্ক্রিমের প্রসঙ্গ আলোকপাত করা যায়। এ স্ক্রিমের আওতায় ওয়াক্ফকৃত অর্থের মুনাফা ৩০টি সামাজিক খাতে বিতরণের জন্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নিজস্ব উদ্যোগ রয়েছে। গ্রাহক সে উদ্যোগে অংশ নিতে পারেন, অন্যথায় এ হিসাবের লাভের অর্থ গ্রাহকের নির্দেশিত স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ব্যাংক পালন করে। বিভিন্ন ইসলামি ব্যাংকের ১ থেকে ২৫ বছর মেয়াদি হজ্ব সেভিংস স্ক্রিম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে একজন সাধারণ আয়ের মানুষও জীবনে একবার হজ্ব পালনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেন।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ, ইসলামী ব্যাংক টাওয়ার, দিলকুশা বা/এ, ঢাকা।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ