প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী : সেই ছোটবেলা থেকে প্রতি বছর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাস ছিল। মাঝখানে তিন বছর করোনার কারণে যাওয়া হয়নি। প্রথম সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলাম ১৯৭৭ সালে। সেবার উঠেছিলাম সীগাল হোটেলে। পর্যটন ব্যবসার তেমন সম্প্রসারণ ঘটেনি। কক্সবাজারও এখনকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ ছিল না। পর্যটকের সংখ্যা এখন বেড়েছে। সমুদ্র সৈকতগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে।
আগে কলাতলী, সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতে জনসমাগম হতো। গত এক দশকে ইনানী, হিমছড়ি ও লাবণী বিচও প্রসারিত হয়েছে। তবে এবার হিমছড়ি সৈকতে গিয়ে সমুদ্রের প্রবল প্রতাপের কাছে সৈকত ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
কক্সবাজার থেকে প্রায় বছর আটেক আগে ইনানী বিচে খোলা জিপে করে গিয়েছিলাম। পথে হিমছড়ি সৈকতটি অপরূপ সৌন্দর্যে গাছপালা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনে হয়েছিল, প্রকৃতির বুকচিড়ে পাহাড়ের কাছে অপরূপ সুধা মাখানো সমুদ্রের লীলাভূমি অনায়াসলব্ধ সৌন্দর্যের অসাধারণ রূপে ধরা দিয়েছে। কোনো নিপুণ শিল্পী বুঝি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এক মোহনীয় ও রমণীয় দৃশ্যের সংযোগসূত্র গাছগাছালি, পাখ-পাখালির মাঝে সৃষ্টি করেছিল।
মনের যাতনা একদিকে সমুদ্রের কাছে সমর্পণ করা যায়, অন্যদিকে দৈবিক আনন্দ বিষাদ বুঝিবা চতুর্দিকের পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যে নিজের কাছ থেকে উধাও হয়ে যায়। গোধূলি লগ্নের কনে দেখা আলোয় দুঃখের মাঝে সংযোগ সূত্র হয়ে প্রকৃতি অধরা হয়ে অস্তগামী সূর্যের লাল আলোয় আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি দেয়- এই বুঝিবা নববধূরূপে প্রকৃতি তার আপন হাজিরা নির্বিঘ্নে মানুষের কাছে, সমাজের ব্যথাতুর দুঃখ কেড়ে নিয়ে নতুনত্বের কাছে ধরা দেবে- মানব হয়ে উঠবে অপার্থিক আনন্দ, প্লেটোনিক ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ।
অথচ এবার হিমছড়ি সৈকতের ফাটল ধরে মন খারাপ হয়ে গেল। সুউচ্চ পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে যেভাবে, গাছগাছালি যেভাবে উজাড় হয়ে যাচ্ছে তাতে মনের মাঝে কেবল আতঙ্ক সৃষ্টি হয়- যেভাবে হিমছড়ি এলাকায় প্রকৃতিকে নিধন করা হচ্ছে, তাতে বুঝি সৌন্দর্যের বদলে অসুন্দর ধরা দেয়। নেই আগের মতো প্রকৃতির আবেশ। বরং প্রকৃতির আপন প্রতিশোধ কখন ঘটে তার জন্যে সযত্ন অপেক্ষা।
এদিকে টেম্পোতে করে হিমছড়ি সৈকত থেকে যখন ইনানী বিচে পৌঁছালাম সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য আজ বিস্মৃত প্রায় ন্যাড়া এবড়োথেবড়ো করে ফেলা হয়েছে। ইনানী বিচ কক্সবাজার থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে। ইনানী বিচে পর্যটকের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। তবে সেখানে এত বছরের মধ্যে এই প্রথমবার আনারকলি ফল খেলাম। সমুদ্রের সৈকতে জোয়ার-ভাটার খেলা দেখার জন্য অনেক সময় ধরে ঘুরে বেড়ালাম। এটিপিতে করে আমার স্ত্রী পুরো সৈকত পরিভ্রমণ করল।
তবে অবৈধ বালু তোলা যেন ইনানী বিচ এবং হিমছড়ি বিচ থেকে বন্ধ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। পাশাপাশি পাহাড় কাটাও বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতি মনের মাধুরী মিশিয়ে যে সৌন্দর্যের লালীভূমি তৈরি করেছে তা যেন যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মনের মাঝে আলোর দেদীপ্যমান শিখায় চির ভাস্বর হয়ে থাকে। রামুর বৌদ্ধ মন্দির ভ্রমণ করে মনে প্রশান্তির ছোঁয়া লাগল। কক্সবাজারে এবার গিয়ে দেখলাম সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। সমুদ্র সৈকতে যেমন সজাগ দৃষ্টিতে ফ্রেশ মাছের বারবিকিউ খাওয়া যায়, ভাজা মাছ খাওয়া যায়- একটু অসতর্ক হলেই বাসি মাছ দিতে কসুর করে না।
তবে টাকার তুলনায় প্রতিটি দ্রব্যের দাম বেশি। স্টারে যে খাসির পায়া পাওয়া যায় ১৩০ টাকায়, কলাতলীর হোটেলে সেই পায়ার দাম পড়ে ২৬০ টাকা। আবার বুকিং ডটকমের মাধ্যমে হোটেলে দুটো রুম বুকিং দিলেও দুপুরে বাংলাদেশ বিমানে গেলেও রাতের মধ্যপ্রহরে হোটেল শী সাইন বুঝিয়ে দেয়। এ এক অদ্ভুত প্রতারণা।
তবে কক্সবাজারে নেটওয়ার্কের স্পিড ঢাকার অনেক জায়গার চেয়ে বেশি। কিন্তু মুশকিল হলো অধিকাংশ দোকান, হোটেলে ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন নেই বললেই চলে। যে হোটেলে উঠেছিলাম, তাদের অনুরোধ করেছিলাম ভবিষ্যতে যেন পিওস রাখে। মুখের ওপর ম্যানেজারের জবাব, এ ধরনের ঝামেলায় আগামীতে যাব না। মেরিন ড্রাইভ সি বিচটিকে আরও সুগঠিত করা যেতে পারে। যেকোনো দ্রব্যই ২৫% থেকে ৪০% বেশি দামে বিক্রি হয়। বাংলাদেশি পণ্য অবলীলায় বার্মিজ পণ্য বলে চালিয়ে দেয়। চ্যালেঞ্জ করলে দোকানদাররা বলে আমরা অতো কিছু জানি না।
কলাতলী বিচ এখনো আগের মতোই। সুগন্ধা বিচটিকে আরও পরিশীলিত ও দেশি-বেদেশি পর্যটকদের উপযোগী করে দোকানপাট গড়ে তোলা দরকার। কক্সবাজারে সবচেয়ে সুন্দরভাবে রেডিয়ান্ট সি ফিসওয়ার্ল্ড তৈরি হয়েছে। এটিকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলা দরকার। টিকিট কাটা থেকে শুরু করে সব পয়েন্টে ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন করা দরকার। শুধু কাপড়-চোপড়ের দোকানে পিওস রয়েছে।
কক্সবাজার যেন পর্যটকদের কাছে ঘিঞ্জি মনে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। সৈকতের ফাটল যাতে রোধ করা যায় সে জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কক্সবাজার বিমান চালানোর ব্যবস্থা করা গেলে সেটি আরও বেশি পর্যটন ব্যবসা প্রসারে সহায়ক হবে। কক্সবাজারে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
১৫ আগস্ট বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের জীবনে কালো দিবস। তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম আসছিল না। মনের আবেগে ছোট্ট কবিতা বঙ্গবন্ধু ও মঙ্গমাতার উদ্দেশে লিখলাম: ‘হে মেহনতী মানুষের মাতা-পিতা/ আজকের এ দিনে জানোয়াররা করেছিল নির্মমতা/ এখনো বাঙালির হৃদয়ে আপনারা সমুজ্জ্বল/ দুঃখী মানুষের ত্রাণকর্তায় উজ্জ্বল।’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১২ নম্বর ওয়ার্ড, কক্সবাজার পৌর শাখায় বিনম্রভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম আমি, আমার স্ত্রী ও ছেলে নাওয়াঝিশ মুহম্মদ আলী। চোখ ঝরে আমাদের অশ্রু। জমায়েত হওয়া শ্রদ্ধেয় কর্মী ও নেতা-নেত্রীরাও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কলাতলীতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনদের ৪৭তম মৃত্যুদিবসে ঘাতকদের প্রতি জানালাম অবনতমস্তকে মনের ভেতর থেকে তীব্র ঘৃণা।
হোটেলে ফেরার পরই ঢাকায় ফেরার তাগাদা। অথচ বিদেশে দেখেছি চার ঘণ্টা অতিরিক্ত টাকা দিয়ে থাকা যায়। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। ১১টায় ছাড়তে হবে। এমনিতেই ভারাক্রান্ত হৃদয়। কিছুক্ষণ সুগন্ধা বিচে দাঁড়িয়ে জলের খেলা দেখতে দেখতে স্রষ্টার উদ্দেশে বললাম, জাতির পিতা-মাতা ও তার সাথে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের রুহের মাগফিরাত করো। তাদের স্মৃতি তর্পণ করতে করতে সমুদ্রের নোনা জলের মতোই চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল।
বিকালে এয়ারপোর্টে দেখলাম জননেত্রী শেখ হাসিনার মহতী কর্মের নিদর্শন- কক্সবাজার বিমানবন্দরকে সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার স্মৃতিচিহ্ন। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ও অন্য শহীদদের জন্যে। অন্যদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্যে দেশ আজ উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘজীবন ও দেশসেবার সুযোগ দিন।
কক্সবাজারকে থাইল্যান্ডের ফুকেটের আদলে গড়ে তোলা হোক। একটি কথা না বললেই নয়,আজ উন্নয়ন হচ্ছে সর্বস্তরে। এ উন্নয়নের মাত্রাকে কাজে লাগাতে হলে সবাইকে কাজ করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি দেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে কক্সবাজারে আসতে না পারে সে জন্য আরও কঠোর হতে হবে। মাদকদ্রব্য ধরার প্রয়াস চোখে পড়ার মতো, তবে যারা গডফাদার তারাও যেন ছাড় না পায়।
কলেজের বন্ধু বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. কাদেরী কলাতলী সমুদ্র সৈকতে দেখা করতে এলো ৪০ বছর পরে। দুপুরের রৌদ্রে দাঁড়িয়ে মনে হলো ফিরে যাই চট্টগ্রাম কলেজের ১৯৮২ ব্যাচের বের হওয়া থেকে। কক্সবাজার হয়ে উঠুক পর্যটনের আদর্শ নগরী।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, আইটি এক্সপার্ট, উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ, কথাশিল্পী এবং শিক্ষক