এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া :
সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।
এক জনে দিলে ব্যথা
সমান হইঢা বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা- সকলের অপমান।
মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা উত্থান,
ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নিচে কাঁপিতেছে শয়তান।
(কুলি-মজুর)
কাজী নজরুল ইসলামের অমর স্মৃষ্টি। আমাদের জাতীয় অস্তিত্বে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সকল সময় ছিল তার অবস্থান। শিল্পী সত্তায় দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এবং মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্খা ও গভীর উপলব্ধি ছিল তার রচনায়। গবেষকদের বিবেচনায়, যুগস্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম অস্তিত্বের প্রকৃত গড়ন সময়ের কামারশালায় বিশ্ব পরিস্থিতির তৎকালীন তাপ-চাপ, অমানবিকতার নিঃসংশয় নির্লজ্জ প্রকাশের পটভূমিতে।
কাজী নজরুল ইসলাম মানতেন- ব্যক্তিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয় সমষ্টির অস্তিত্ব ও অবস্থিতি। সকল ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ড জীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ; দরিদ্র-অশিক্ষিত-ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য রুটি-কাজ আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় সাজিয়েছেন কবি তাঁর কথামালায়। নজরুল ছিলেন জনতার কাতারের দাঁড়ানো এক শক্ত মানুষ; ফাঁকবিহীন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় তিনি ছিলেন অকুতোভয় সৈনিক।
কাজী নজরুল ইসলামের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাংলা কবিতায় বড় বেশি প্রয়োজন। প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাস নজরুল সম্পর্কে বলেছেন- “নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।”
কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ ছিল আলাদা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর উপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের উপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে। তাই জনদরদি রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছেন তার রচনায়। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। একদিকে যেমন বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখেছেন এবং অসহায় মানুষদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাম্যের গান শুনিয়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি কোমল হদয়ের সন্ধান দিয়েছেন। তেমনি সর্বমানবের মুক্তি এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা নজরুলের যেমন উদ্দেশ্য তেমনি মার্কসেরও উদ্দেশ্য। তবে পার্থক্য শুধু আদর্শগত। নজরুল মার্কসের মতো বস্তুবাদী ছিলেন না। মানবসমাজের ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আলোচনাও করেননি। কেবল সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় সাম্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে।
এখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারন করেছেন :
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
বিশেষ এক কালপর্বে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। দেশ-কালের সঙ্গে তাঁর অন্তরাত্মার যে যোগাযোগ, সেই শক্তি তাঁকে কালান্তরে মহানায়কের ভূমিকায় আসীন করেছে। ক্রান্তি-সঙ্কটের এই বর্তমানে নজরুল আমাদের আরো অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং নমস্য। সমূহ অন্যায়-অবিচার আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপক্ষে তাঁর স্বভাবজ আবেগের স্পন্দন-বিলোড়নের অন্তরালে আন্তরসত্যে অঙ্গীকার ছিল সুদৃঢ়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা, তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে প্রহরে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের ও জাতির শান্তি রক্ষায় কিংবা পারস্পরিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তাঁর যে অভিব্যক্তির প্রকাশ, তা জাতীয় চেতনার প্রতি তাঁর প্রবল বিশ্বস্ততাকেই ধারণ করে। হিংসামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূল সাধনা ছিল জাতি-ধর্মের-গোত্রের বিভেদমোচন। মুক্তি-প্রয়াসী নজরুল আইরিশ বিদ্রোহী রবার্ট এ নেট (কহন মিশ্র ছদ্মনামে নজরুল রচিত জীবনী-ধূমকেতু, ১ম বর্ষ, ১৫ সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৯)-এর ভূমিকাংশে লিখেছেন- ‘সকল দেশের মুক্তির পথের যাত্রী আমাদের নমস্য। জগতে এই তীর্থযাত্রার আরম্ভ মানবের সৃষ্টিকাল হইতে আরম্ভ হইয়াছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে আভিজাত্যের বিপক্ষে যে অভিযান তাহার পন্থা যাহাই হোক না কেন, সে অভিযান যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত. সাফল্যের মাপকাঠিতে তাহার বিচার চলে না, কারণ মানুষ বাঁচে তাহার চেষ্টাতে, সাফল্যে নয়। মুক্তি লাভের আদর্শ মানব-সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন আকার ধারণ করে। কোথাও তাহা ধনাভিজাত্যের বিপক্ষে উঠিয়াছে, কোথাও বা প্রতিষ্ঠিত অত্যাচারমূলক রাজ ব্যক্তির বিপক্ষে, কোথাও বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে… এই যে সমাজের বা রাজশক্তির বা যে কোন প্রকার আভিজাত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সেই বিদ্রোহের শক্তি আমরা চাই। ’ নজরুল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অপশক্তির মূল উৎপাটনের দিকেও সচেতন মানুষের বিশেষ দৃষ্টি কামনা করেছেন এবং তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যে রাজশক্তি মানুষের প্রতি পাশবিক আচরণ করে, যে রাজশক্তি অগণন নারীকে বিধবা কিংবা সন্তানহারা করে, সেই রাজশক্তির ধ্বংস অনিবার্য। জাগ্রত জনতাই নজরুলের আরাধ্য ছিল। তাই জাগ্রত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মবিদ্বেষ দৃষ্টিগোচর হয়নি তাঁর। দেখাননি জাতিবিদ্বেষও। তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের মধ্যে ধর্মবিদ্বেষ নাই, জাতিবিদ্বেষ নাই, বর্ণবিদ্বেষ নাই, আভিজাত্যের অভিমান নাই। পরস্পরকে ভাই বলিয়া একই অবিচ্ছিন্ন মহাত্মার অংশ বলিয়া অন্তরের দিক হইতে চিনিয়াছি। ’ জাতি-গোত্র কেন্দ্রিক হানাহানি থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার সাগরে ভাসবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মানুষের ও সমাজের মূল্যবোধ পরিবর্তনের অনুপ্রাণিত ঢেউ। নজরুল খেটে-খাওয়া মানুষের জয়ধ্বনি করেছেন। আর এই জয়ধ্বনি থেকে পরবর্তী বাংলা কবিতায় নবযুগের অধিকারবোধে এসেছেন একে একে সুকান্ত ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাঠ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুন মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তরা। যার ফল, সাম্যবাদী চিন্তাধারায় আরও পরিপুষ্টি। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করে নয়, নিজস্ব চিন্তা-চেতনার বশবর্তী হয়ে সমাজের সর্বস্তরের অসাম্যের প্রতি বিরোধিতা করতে গিয়ে, নজরুল সাম্যবাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।
সমকালের অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক ও রাজনীতি সচেতন বাঙালির মতো কাজী নজরুল ইসলামকেও বাধ্য হয়ে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, সর্বহারা শ্রেণি, শ্রমিক, শ্রম-শোষণ, বাজার, মুনাফা, পুঁজি, উদ্বৃত্ত ইত্যাদি পরিভাষার মর্মার্থ আত্মস্থ করতে হয় সময়ের একান্ত প্রয়োজনে। একই সঙ্গে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও এর আলোকে বিশ্ব সমাজকে পর্যবেক্ষণ, বিশ্নেষণ করার পদ্ধতিটিও রপ্ত করতে হয়। লক্ষণীয়, তার স্বকালই নজরুলের চৈতন্য গড়ে দিচ্ছে বিপরীতধর্মী বিচিত্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষতের দাগ গায়ে আঁচ পড়তে দেননি কাজী নজরুল ইসলাম। সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ পদচারণায় মানুষের মাঝে আশা আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন সারাজীবন নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে। আর্থিক দুর্যোগের মাঝে ১৯৪০ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রী প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত তাকে বিছানায় যন্ত্রণাকর জীবন কাটাতে হয়।
১৯৪১ সালে ২৫শে মে কবির ৪৩তম জন্মজয়ন্তীর পরের বছরই ২০ আগস্ট নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার এগারো বছর পর নজরুলের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। লন্ডন ও ভিয়েনার চিকিৎসাদল পরীক্ষা করে দেখেন নজরুল আর আরোগ্য লাভ করবেন না। এইভাবে তার সমসাময়িক সবচেয়ে বাকপটু স্পষ্টবাদী নজরুল স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচিত Introducing Nazrul Islam বইতে চমৎকার লিখেছেন, “নজরুলের জীবন বাঙ্গালী প্রকৃতির মতো। তিনি তাঁর জীবন যাপন করেছিলেন পরিপূর্ণভাবে, সাহসিকতার সাথে, বৈশাখ মাসের মতো। কিন্তু তার চেয়ে ভাল একটি নাটকের মত। যেখানে আছে অনেক দৃশ্য, তাছাড়া আছে, যেমন থাকা দরকার হয় ভালো নাটকে, অনবরত কর্মের ঐক্য, সততার উদ্দেশ্যমূলকতার ঐক্য।”
বাঙ্গালির অন্তিত্বের কবি ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারত থেকে ঢাকায় আসেন এবং তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ২৪ মে (১৩৭৯ সনের ১০ জ্যৈষ্ঠ) কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়, বাংলাদেশ বিমানে করে। ইতিহাস পযঅলোচনা করলে থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র আটদিন পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কাজী নজরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসার প্রাথমিক আমন্ত্রণ জানানো হয় ভারত সরকারকে। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এর মাত্র পাঁচদিন পর স্বামীর পক্ষে জোহরা তাজউদ্দীন এ আমন্ত্রণপত্র কবির কাছে পৌঁছে দেন।জবাবে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়, শিগগিরই তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন।
এর মাত্র দেড় মাস পরেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে যান ভারতে। অবস্থান করেন ১৯৭২ সালের ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় পৌঁছেই বঙ্গবন্ধু কবির সুস্থতা কামনা করে তাকে দুইটি ফুলের তোড়া পাঠান। এরপরের দিন কবির দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ সস্ত্রীক রাজভবনে শেখ মুজিবুরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু তার সরকারের পক্ষে নজরুলের পুত্রদের কাছে কবিকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে দুই ভাই ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। এ সফরে তারা অসুস্থ কবিকে কীভাবে বাংলাদেশে আনা যায়, তা নিয়ে তারা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনতে কালক্ষেপণ করতে চাননি বঙ্গবন্ধু। ফলে কবিকে বাংলাদেশের আসার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের মধ্যে মার্চ ও এপ্রিল মাসজুড়ে চিঠি চালাচালি হয়। কবিকে ঢাকায় আনার জন্য কাজী সব্যসাচী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও আলোচনা করেন। সব কূটনৈতিক তৎপরতা শেষে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৭২ সালের ২৫ মে’র কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, সেদিন সকালে কবির পুত্রবধূ তাকে গোসল করান। পরে সিল্কের নতুন পাঞ্জাবি ও ধুতি পরান। কবিকে খাইয়ে সোজা নিয়ে আসেন কলকাতা বিমানঘাঁটিতে। বিমানঘাঁটির নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনালে কবিকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধি, রাজ্য সরকারের লিয়াজোঁ অফিসার ও কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিমানে কবির কোনো অসুবিধা না হলেও কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত কবি সম্পূর্ণ নীরব থাকেন।
ঢাকার চিত্র তখন উৎসবের মুখর। সকাল থেকেই কবিকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেন তার অনুরাগীরা। বিমানবন্দর ভবনের ছাদ ও রানওয়ের একাংশ সকাল ১০টার মধ্যে অসংখ্যক মানুষে ভরে যায়। যারা এসেছিলেন তাদের প্রায় সবার হাতেই ছিলো ফুলের মালা।
সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান ঢাকা বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়ে যায়। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি কোরবান আলী কবিকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভ্যর্থনা জানান।
বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান জনতা গণবিদারী স্লোগানে স্বাগত জানান চির বিদ্রোহীকে। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে বিমানের চারপাশে ঘিরে ধরে জনতা। ফলে কবিকে বিমানের ভেতর থেকে বাইরে আনাটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। নিরাপত্তা পুলিশ ২০ মিনিট চেষ্টা করেও জনতাকে দূরে সরাতে পারেনি।
পরে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, কবি অত্যন্ত অসুস্থ। আপনাদের খুশি করার জন্য তবুও আমরা তাকে বাংলাদেশে এনেছি। এরপর বিমানের দরজা থেকে নামানো হয় কবিকে। পরে তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। চোখের দেখা দেখতে না পাওয়া জনতা ভালোবাসার অর্ঘ্য হিসেবে অ্যাম্বুলেন্সের ওপর ফুল ছুঁড়তে থাকেন। সেখান তাকে সরাসরি ধানমন্ডিতে তার জন্যে নির্দিষ্ট বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানেও বিমানবন্দরের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। কবিকে এক নজর দেখতে বাড়ির সামনের আঙিনা, এক ফালি সবুজ লন, টানা বারান্দা সবখানেই ভিড় জমান অনুরাগীরা।
কবিকে ধানমন্ডির বাসভবনে নিয়ে আসার ঘণ্টাখানেক পরেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাকে দেখতে আসেন। কবি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি কবির শয্যার পাশে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে তিনি চলে যান। সে সময় তিনি মন্তব্য করেন, কবির ঢাকায় আগমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা চিরদিন স্মরণ করা হবে।
দুপুরে পর বিকেলে বঙ্গবন্ধু স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। বঙ্গবন্ধু সস্ত্রীক কবির কক্ষে ঢুকে তাকে শুয়ে থাকতে দেখেন। পরম শ্রদ্ধায় কবির মাথায় বঙ্গবন্ধু হাত রাখতেই তিনি চোখ মেলে তাকান। আবেগতাড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সেময় বলেন, আমি এসেছি। আমি মুজিব এসেছি। আমি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।
পর দিন দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কবির সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবৃত্তি করেন, তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এর পরে কবি ঘোলাটে চোখে কবি শুধু একবার তাকান শেখ মুজিবুরের দিকে।
কবিকে সামনে রেখে ঢাকায় নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনের জন্য। বাংলাদেশে আসার পর কবির জন্য সরকারি উদ্যোগে পুরনো ২৮নং রোডের ৩৩০/বি ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাড়িটি বরাদ্দ করা হয়। সেই সময়ে বাড়িটির নামকরণ করা হয় ‘কবিভবন’। সেখানে কবিকে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাদিতে ভূষিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
ধানমণ্ডির বাড়িতে কবি কাটিয়েছেন তিন বছর এক মাস ২৯ দিন। কবিভবন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭নং কেবিনে। পিজি হাসপাতালে কবি মৃত্যু পর্যন্ত, অর্থাৎ ছয় মাস ১১ দিন কাটিয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা হয়। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনো দলিল পাওয়া যায়নি। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংসদে আইন পাস করে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
এটা সত্য যে, সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশও প্রণীত হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য স্বীকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে সংকটে যে চেতনা, তার নাম মানবতা। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনার, তার নাম মানবতা। আজকের পৃথিবীর অন্যতম বড় সমস্যা দেশে দেশে বিরাজমান ধর্মীয় সংকীর্ণতা, ধর্ম নিয়ে জঙ্গিপনা। নিজ নিজ ধর্ম রক্ষার দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সারা বিশ্বে-প্রায় প্রতিটি সমাজে।
সব দেশেই এ কাজে বেশি ভূমিকা রাখতে দেখা যায় সমাজপতি বা ধর্মীয় মোড়লদের। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র চেতনার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। বর্তমান সময়ের আরেকটি বড় সমস্যা নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার-নিগ্রহ এবং তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যৌন সন্ত্রাস।
আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি প্রগতিশীল, গণতন্ত্রকামী সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক আন্দোলনে নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা এ সূত্রেই নিরূপিত।’ তবে বর্তমান বিশ্বে চলমান মানবতার সংকট, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রবণতা থেকে মুক্তি পেতে কাজী নজরুল ইসলামে অমর বাণীসমৃদ্ধ কবিতাপাঠের বিকল্প নেই।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মজয়ন্তীতে। তার প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
[ রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি – বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]