প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে ৭২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ২০ বছর আগে চীনের মূল ভূখণ্ড এবং হংকংয়ে সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মৃতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত নতুন করে ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছে, যাদের ৮১ জনেই হুবেই প্রদেশের। সেইসঙ্গে ৩ হাজার ৩ শত ৯৯ জন নতুন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর হুবেই প্রদেশের উহান শহরেই প্রথম এই ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। যদিও এ রোগে বাংলাদেশে কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। এই ভাইরাস মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
তবে ভাইরাসটি যেহেতু মানুষের মাধ্যমে ছড়ায় সেহেতু সীমান্তবর্তী সকল বর্ডারে এখন থেকেই নজরদারি বাড়ানো উচিৎ। বাইরের দেশ থেকে যাত্রী আসলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয়। কারণ একবার কোনো বিদেশি যাত্রীর মাধ্যমে এই ভাইরাস ঢুকে পড়লে আমাদের হয়তো কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পরামর্শ অনুযায়ী এই মুহূর্তে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশের সবাইকে মাস্ক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।আর এই ভাইরাসের লক্ষণ কোনো এলাকায় দেখা দিলে তা চেপে না রেখে সরাসরি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নজরে আনা জরুরি।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই ভাইরাস যেহেতু ছোঁয়াচে সেহেতু এটি প্রতিরক্ষার দায়িত্বও আমাদের নিজেদের। আমরা সবাই যদি একটু সচেতন এবং সতর্ক হই সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি, বাইর থেকে এসে হাত মুখ পরিষ্কার করি ও বাইরে মুখে মাস্ক ব্যবহার করি তাহলে এই ভাইরাস থেকে আমরা অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবো।
এর বাইরে সরকারের উচিত, এ বিষয়ে জনগণকে আগেভাগেই সতর্ক করা। প্রয়োজনে প্রচার মাধ্যমে ঘনঘন করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিজ্ঞাপন প্রচার করা। দেশের প্রান্তিক মানুষদের এই ভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সমাজকর্মীদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করবো সরকার এমন একটা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগেভাগেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে জনগণকে সুরক্ষিত রাখবেন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কর্মকর্তারা বলেছেন, এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ৩২ জনের শ্বাসনালি থেকে লালার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কারও নমুনায় করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। এই রোগটি নির্ণয় ও এর চিকিৎসার জন্য সরকার প্রস্তুত আছে।
এ পর্যন্ত ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই রোগ শনাক্ত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ পর্যন্ত ১৪১ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৭ জন মারা গেছে। গত সপ্তাহে রিয়াদের প্রিন্স সালমান হাসপাতালে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়।
সরকারি সূত্র জানায়, সৌদি এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমানে ফেরা হজযাত্রীদের কাছ থেকে একটি হলুদ রঙের ফরম পূরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ফরমে এমন কিছু প্রশ্ন আছে, যার উত্তর পেলে সন্দেহভাজন ব্যক্তি শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু সেই ফরমটি পূরণ করিয়ে নেওয়ার কাজটি যথাযথভাবে হয়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশ থেকে আসা যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআর বলেছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি এবং কাশি ও মারাত্মক শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দেহে মার্স-করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বলে ধরা যায়। এ ক্ষেত্রে অতিসত্বর নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। এই ভাইরাসে শ্বাসকষ্ট খুব বেশি হয়। সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনা ভাইরাস কত দ্রুত ছড়ায় তা এখনো অজানা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এ বিষয়ে যে গুটিকয়েক দেশে রোগ নির্ণয় করার পরীক্ষাগার আছে, বাংলাদেশ তার একটি। স্বাস্থ্য অধিদফতর এ ব্যাপারে সতর্ক আছে। আইইডিসিআর সূত্র বলছে, মার্স ভাইরাস বিষয়ে রাজধানী ঢাকার প্রধান হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকরাও এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। রোগের প্রকোপ দেখার জন্য ২৩টি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। রোগগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। দেশবাসী করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে সতর্ক হবেন- এটাই প্রত্যাশা।
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে খবর প্রথম জানিয়েছিলেন চীনের চক্ষু বিশেষজ্ঞ লি ওয়েনলিয়াং। এজন্য তিনি সতর্কও করেছিলেন সবাইকে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। পরে ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে এবং অনেক মানুষের মৃত্যু হলে নায়কোচিত প্রশংসা পান ঐ চিকিৎসক। তবে শেষ রক্ষা হয়নি ওই ডাক্তারেরও। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই মারা যান লি।
এই ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ইতিমধ্যে পৃথিবীর আরো বেশ কয়েকটি দেশে দেখা দিয়েছে। যদিও এ রোগে বাংলাদেশে কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর এখনও পাওয়া যায়নি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই রোগটির প্রতিষেধকই খুঁজে পাচ্ছেনা।
কারণ এই রোগটির লক্ষণ নিউমোনিয়ার মতো হলেও কোনো ওষুধই কাজ করছেনা, ফলে এই ভাইরাস নিয়ে ইতিমধ্যে চীনসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে হৈচৈ শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চীনের উহান প্রদেশে গত ১১ জানুয়ারি একজন মানুষের প্রথমে শ্বাসকষ্ট তারপর সর্দি – কাশি হওয়ার পর চিকিৎসকগণ স্বাভাবিক নিউমোনিয়ার চিকিৎসা করে লোকটিকে বাঁচাতে না পারায় তাদের মধ্যো প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল এ রোগ আদৌ নিউমোনিয়া কীনা, কিন্তু পরবর্তীতে এ রোগে উক্ত প্রদেশে আরো ১৬জনের মৃত্যু হলে চীনসহ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নড়েচড়ে বসে এবং এই ভাইরাসকে সনাক্ত করে।
সনাক্তে দেখা যায় এটি নিউমোনিয়া নয় এটি ‘করোনা’ নামক একটি ভাইরাস যার সংক্রামণে মানুষ দ্রুতই মৃত্যুর দিকে ধাপিতো হতে পারে। এ রোগের পুরো লক্ষণ দেখা দিতে সাধারণত ৫ দিন লাগে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর প্রথমে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তারপর জ্বর, সর্দি, কাশি দেখা যায় এবং রোগি একসময় শ্বাস নিতে না পেরে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।
অর্থাৎ এই ভাইরাস সরাসরি মানুষের ফুসফুসকে প্রথমে আক্রান্ত করে তার শ্বাসনালীকে অকার্যকর করে দিয়ে মানুষের শারীরকে পুরোপুরি অকেজো করে দেয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাস মানুষের হাঁচি এবং কাশির মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই চীনের উহান প্রদেশসহ যে সকল দেশ কিংবা অঞ্চলে এই ভাইরাসটি দেখা গেছে সে সমস্ত অঞ্চলের সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অনুরোধ করেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মধ্য চীনের উহান প্রদেশের সামুদ্রিক একটি খাবার থেকে এই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে আশংকা করছেন।
উহান প্রদেশের এক সামুদ্রিক বাজারে এক ধরনের মাছ পাওয়া যায় যা স্থানীয় চীনারা রান্না করে খায়। এই মাছটি হচ্ছে ‘বেলুগা’ জাতীয় তিমি এই তিমি মাছই সাধারণত করোনা ভাইরাস বহন করে। প্রাণি থেকে কোনো ভাইরাসের সংক্রমণ অবশ্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও ইঁদুর থেকে প্লাগ, বাদুড় থেকে নিপাহ ইত্যাদি ভাইরাস রোগ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ব্যাপক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। তবে পরবর্তীতে এসব রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হলে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা
বিজ্ঞানীরা বলেন-এই ভাইরাসটি সহজে ধ্বংস না হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে “ভাইরাসটি হয়তো ইতিমধ্যে মানুষের দেহকোষের ভেতরে প্রবেশ করে তার গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ ধারণ করেছে। তাই কোন ওষুধই কাজ হচ্ছেনা। বরং এটি দিনদিন ভয়ংকর হয়ে ওঠছে।
চীনসহ বিশ্বের ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এসব দেশ ও অঞ্চলে ৩১০ জনের বেশি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের চীন ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের চীন থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে।