মো. মিজানুর রহমান, এফসিএস: শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠান নিয়ে বিড়ম্বনার যেন শেষ নেই। অনেকটাই জিম্মি হয়ে পড়েছে কিছু শেয়ারহোন্ডারদের কাছে। যারা এজিএম পার্টি নামে সমধিক পরিচিত। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরাও নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে এজিএম পার্টির অনৈতিক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু তাই না, এজিএম অনুষ্ঠানে এজিএম পার্টির অশোভন আচরণের শিকার হন কোম্পানি সেক্রেটারি, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিড়ম্বনা আর তাচ্ছিল্যের কারণে তাঁরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন না। এজিএম শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব সময়ই তাঁদের যেন এক ধরণের আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে।
একটা সময় ছিল যখন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে অনেক অনিয়ম ও আর্থিক বিশৃঙ্খলা ছিল, কিন্তু এখন অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। লোকবল বৃদ্ধি ও পেশাদারিত্বের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। ফলে, এখন তাদের কার্যকর ভূমিকায় এজিএম নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও বিড়ম্বনার অবসান হতে পারে।
এজিএম পার্টির কারণে সুশৃঙ্খল পরিবেশে এজিএম অনুষ্ঠানের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে আছে। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এ সময় দেখা যায় সবচেয়ে অসহায় অবস্থায়। তাদের নূন্যতম সৌজন্যটুকুও দেখাতে পারেন না আয়োজকরা। জানা গেছে, আগে এজিএম উপলক্ষে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য সামান্য উপহার এবং চা-নাস্তার ব্যবস্থা থাকতো। বর্তমানে বাংলাদেশ সিকিউটিরিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও স্টক এক্সচেঞ্জ শেয়ারহোল্ডারদের সামান্য উপহার প্রাপ্তি ও নাস্তার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। কিন্তু অদ্যবধি এজিএম পার্টির দৌরাত্ব বন্ধে তাদের কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কোম্পানিগুলোর এজিএম অনুষ্ঠানেও বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই’র কোন প্রতিনিধি থাকেন না। ফলে, তাঁরা হয়তো জানতেও পারেন না, এজিএমের নামে আসলে কি অরাজকতা হচ্ছে।
একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কোম্পানি সেক্রেটারির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা এই পদে আছেন, তাঁদের এজিএমের নামে নৈরাজ্যকর অনুষ্ঠানের তিক্ত অভিজ্ঞতায় অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। অনেক সময় দেখা যায়, কোম্পানির চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও সহ পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সুবিধামত সাধারণ সভায় এজেন্ডা পাশ করিয়ে নেওয়ার জন্য এজিএম পার্টির সাথে আর্থিক সমঝোতায় যায় এবং এই বিষয়টি এখন প্রায় ওপেন সিক্রেট। প্রতিষ্ঠানগুলো ধরেই নিয়েছে, এজিএম পার্টির সাথে হাত মেলানো ছাড়া এজেন্ডা পাশ করানো সম্ভব না। যে কারণে, এজিএম পার্টি ক্রমেই আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষা।
এজিএম পার্টিতে শেয়ারহোল্ডারদের অশোভন আচরণের ভয়ে অনেক পেশাদার ব্যক্তি কোম্পানি সেক্রেটারি পেশায় আসতে চান না। যোগ্যতা থাকা সত্বেও মেয়েরা এ পেশা থেকে নিজেদের দূরে রাখেন। আবার কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরাও মেয়েদের সিএস পদে নিয়োগ দিতে সাহস পান না। তার একমাত্র কারণ, এজিএম বিড়ম্বনা ও এজিএম পার্টির উৎপাতের ভয়। যে কারণে চার্টার্ড সেক্রেটারি হিসেবে পেশাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আইসিএসবি’র অনেক মহিলা সদস্য কোম্পানি সেক্রেটারির মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃক নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণভাবে সাধারণ সভা পরিচালনার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। তাহলেই এজিএম এর শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। প্রচলিত কোম্পানি আইন-১৯৯৪ ও বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধি-বিধানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোন জোড়ালো বা শক্ত ভিত্তি নেই।
অনেক সময় দেখা যায়, কোম্পানিগুলো পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে, কিন্তু এজিএম করার সময় চলে যায় ঢাকার বাইরে, যাতে ঢাকার বা ঢাকার বাইরের বিনিয়োগকারী সদস্যরা এজিএম এ অংশ নিতে না পারেন। মোটকথা, আমাদের প্রচলিত আইনী কাঠামোতে সব ক্ষমতাই আসলে পরিচালনা পর্ষদের হাতে, সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কার্যত কোন ক্ষমতাই নেই কিছু করার। তারা না পারে লভ্যাংশ বাড়াতে, না পারে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে কোন পরিবর্তন করতে। নিরীক্ষক নিয়োগ হয় বোর্ডে, অনুমোদন হয় এজিএমে। আবার অনুমোদন না দিলেও কোন নিরীক্ষক নিয়োগ কখনও বন্ধ বা পরিবর্তন হয়নি। তুরুপের তাস থাকে সব সময় পরিচালনা পর্ষদের হাতে, তারা যা করবেন, তাই হবে। তাহলে শুধু শুধু এজিএম এর দরকার কী? খামাখা একটা বাড়তি ঝামেলা না করলেই বরং ভালো, এছাড়া কোম্পানিরও অনেক টাকা সাশ্রয় হয়-এমনই বিক্ষুব্ধ মনোভাব পোষণ করেন সংশ্লিষ্টরা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকায় প্রতিষ্ঠান বড় করে কর্তাব্যক্তিরা মোটা অংকের বেতন, নানা প্রকার সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন, আবার এজিএম পার্টি দিয়ে তাদেরকেই অপমান অপদস্ত করছেন। অথচ এর নেই কোন প্রতিকার বা পরিবর্তনের আভাস। সবাই কার্যত: অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকে। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার এবং বর্তমান সরকার ইচ্ছে করলেই তা সহজেই করতে পারে।
ভুক্তভোগীরা মনে করেন, এজিএম পার্টির দৌরাত্ব বন্ধ করতে হলে, প্রচলিত কোম্পানি আইন, স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসি’র বর্তমান রুলস ও রেগুলেশন দ্বারা এ সমস্যার সমাধান সম্ভব না। এক্ষেত্রে নতুন কোম্পানি আইন ও বিএসইসি’র কার্যকর ভূমিকা প্রবর্তনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে এজিএম বাস্তবায়নে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে এবং কেবল তখনই এজিএম বিষয়ে পুঁজিবাজারে শান্তি ফিরে আসবে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য মতামত প্রদান করতে পারবেন।
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ডটকম; ফেলো, আইসিএসবি ও কলামিষ্ট