মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, এনডিসি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান। এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সেতু বিভাগের সচিবের। আসছে বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন একটি দৈনিক পত্রিকার সাথে।
প্রশ্ন: আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার কেমন বাজেট দিচ্ছে?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাজেট হলো আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা। এনবিআর শুধু আয়ের দিকটি দেখে। জনগণের কাছ থেকে করের মাধ্যমে আয় করে সরকারকে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। তবে মানুষের ওপর বোঝা না চাপিয়ে কর আদায়ের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। বাজেটের আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় রেখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও বাড়াতে হবে এনবিআরকে। তবে বড় লক্ষ্য অর্জনে মানুষকে কষ্ট দেয়া হবে না। আসছে বাজেটে নিম্নবিত্ত মানুষকে কিছুটা স্বস্তি ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সুবিধা দিয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: এবারের বাজেটকে নির্বাচনের বাজেট হিসেবে দেখছেন সবাই। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আগামী অর্থবছর নির্বাচনের বছর হলেও রাজস্ব নীতিতে নির্বাচনের প্রভাব থাকবে না। নির্বাচনের প্রতিফলন মূলত বাজেটের ব্যয় কাঠামোর মধ্যে থাকে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ (এডিপি) বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে আয় কাঠামো আগের ধারাবাহিকতার আলোকেই প্রণয়ন করতে হবে। আয়ের ক্ষেত্রে এনবিআরের ফিসক্যাল পলিসি জনকল্যাণমুখী করা হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন করবে এনবিআর। সার্বিক বিবেচনায় আমি বাজেটকে নির্বাচনমুখী না বলে একটি সুষম বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করব।
প্রশ্ন: বাজেটে কর কাঠামো কেমন হচ্ছে?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাজেটকে সুষম করার ক্ষেত্রে কর কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারো ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে একটি উন্নয়ন ও বিনিয়োগবান্ধব কর কাঠামো তৈরি করব। স্থানীয় উদ্যোক্তারা যেন নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহী হন— এমন নীতিসহায়তা থাকবে এবারের বাজেটে। আয়করের ক্ষেত্রে ব্যক্তিশ্রেণীর জন্য খুব একটা পরিবর্তনের সুযোগ নেই এবার। অধিকসংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনতে ও কর দেয়ার অভ্যাস তৈরি করতে করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ানোর চিন্তা রয়েছে আমাদের। কোম্পানি কর ব্যবসাবান্ধব করতে কাজ করছি আমরা। লভ্যাংশে বারবার করারোপের বিষয়টি শিথিল করা নিয়েও কাজ করছি। ভ্যাটের ক্ষেত্রে একটু ছাড় দিয়ে বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। স্থানীয় শিল্পকে সুবিধা দিতে পণ্য আমদানিতে কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
প্রশ্ন: স্থানীয় শিল্পকে প্রণোদনা দেয়ার কথা বলছিলেন। বিষয়টি কেমন হবে…
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: আমি বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময়ই স্থানীয় শিল্পের সমস্যাটা পর্যবেক্ষণ করেছি। একটি শিল্পকে নতুন করে দাঁড় করাতে কর অবকাশ সুবিধাসহ কিছু সুযোগ দিতে হয়। দেশে উৎপাদন শুরু হওয়া পণ্যটি যেন অন্য দেশ থেকে সহজে প্রবেশ করতে না পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়। এবারের বাজেটে আমরা এমন কিছু উদ্যোগই নিচ্ছি। যেসব পণ্য আমাদের দেশে উৎপাদন হয়, সেগুলো আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানোর মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তাছাড়া আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে করপোরেট করহার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাংলাদেশে করপোরেট করহার আসলেই বেশি। ব্যবসায়ী সংগঠনসহ সবাই এটাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সুপারিশ করেছে। এটিকে যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে আমাদেরও পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেও করপোরেট কর নিয়ে আমরা কথা বলেছি। তবে রাজস্ব আহরণের কথা চিন্তা করে এটিকে হঠাৎ কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। আমাদের লক্ষ্য হলো, করপোরেট কর ধীরে ধীরে কমিয়ে একটি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা।
ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে করের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। বিষয়টি কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন?
ফেসবুক, ইউটিউব ও গুগলসহ দেশের বাইরে অবস্থানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দেয়া বিজ্ঞাপনের ওপর থেকে প্রযোজ্য ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আদায়ে উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা মূলত যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রদান করছে, তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করব। তবে বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্মগুলো যেন বাংলাদেশে নিবন্ধন নিয়ে কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসা করে, সে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। ঢাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের হাব অফিস স্থাপনে কাজ করতে আমাদের সঙ্গে এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আরো পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে।
উবার, পাঠাওয়ের মতো অ্যাপভিত্তিক সেবাকে করের আওতায় আনতে বিভিন্ন পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা আসছে। আপনারা কী ভাবছেন?
উবার ও পাঠাওয়ের মতো পরিবহন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। এগুলোকে এখনো করের আওতায় আনা যায়নি। এবারের বাজেটে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকবে। আয়করের পাশাপাশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব পরিবহন থেকে ভ্যাটও আদায় করবে এনবিআর। পাশাপাশি দেশের সব বাস, ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশার মালিকদের করের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হবে।
অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর নতুন ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তবে আইনের অনেক কিছুই এবার বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে…
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ২০১৯ সাল পর্যন্ত স্থগিত করেছে। ওই সময় আইনটি বাস্তবায়নে যেন আর সমস্যা না হয়, সে লক্ষ্যে কাজ করছে এনবিআর। ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে এ লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে পুরনো আইনেই আমরা এবার অনলাইনে যাচ্ছি। এজন্য বিদ্যমান আইনের কিছু বিধি সংশোধন করা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হলো, ভ্যাটের একক ভিত্তি ১৫ শতাংশ না রেখে বিভিন্ন স্ল্যাব করা; যেন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি না হয়। ভ্যাটে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।
প্রশ্ন: বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা কেমন হচ্ছে? বাস্তবায়নে এনবিআর কী কৌশল নেবে?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাজেটের আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেট চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রাও বাজেটের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারণ করা হবে। চলতি অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা এরই মধ্যে সংশোধন করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা ২৭-৩০ শতাংশ বাড়তে পারে।
প্রশ্ন: এবারের বাজেটে রাজস্ব আয়ের চাপটা কোন শ্রেণীর মানুষের ওপর বাড়ছে?
মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাজেটের রাজস্বের চাপ যেন কারো ওপরই না পড়ে, সে বিষয়ে আমরা লক্ষ্য রাখব। আমাদের পরিকল্পনা হলো সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে ব্যবসা থেকে রাজস্ব আহরণ করা। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদেরও যেন কষ্ট না হয়, সে বিষয়টি মাথায় রাখা হবে। ব্যবসার পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায় করব। অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণে আমাদের লক্ষ্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি জড়িত থাকা রাজস্বের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারলেই রাজস্ব আহরণ বেড়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা