নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা হতে চুরি ও ছিনতাইকৃত অবৈধ মোবাইলফোন চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতাসহ ২০ জনকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)।
সোমবার (১ এপ্রিল) রাজধানীর গুলিস্তান, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকা অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে আইএমইআই পরিবর্তন করার ডিভাইস সহ প্রায় ৯০০টি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশি ও বিদেশি স্মার্টফোন উদ্ধার।
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ অসাধু দুষ্কৃতিকারী চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবত চোরাই ও ছিনতাইকৃত বিভিন্ন আধুনিক মডেলের এনড্রয়েড মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর গুলিস্তান, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
জানা যায়, একদল সংঘবদ্ধ অসাধু দূস্কৃতিকারী চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন যাবৎ চোরাই ও ছিনতাইকৃত বিভিন্ন আধুনিক মডেলের এনড্রয়েড মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছে। পরবর্তীতে এ সমস্ত মোবাইল ফোন বিভিন্ন অপরাধীরা ক্রয় করে বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করে মোবাইল সিন্ডিকেট চক্র ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের বাণিজ্য নিয়ে তৎপর রয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে যে এসময়টিতে মোবাইল ছিনতাইয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়। ছিনতাই হওয়া এসকল মোবাইল ফোন বিভিন্ন মার্কেটের সম্মুখে অস্থায়ীভাবে দোকান স্থাপন করে বিক্রি করে থাকে। এছাড়াও চক্রটি ঢাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে চুরি এবং ছিনতাই হওয়া এসকল মোবাইল ফোন সুকৌশলে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের যোগসাজশেও ক্রয়-বিক্রয় করতো। এসকল মোবাইল চোরাকারবারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৩ এর ৪টি অভিযানিক দল রাজধানীর গুলিস্তান, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে খিলগাঁও এলাকার সংঘবদ্ধ মোবাইল চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতা ১। হাফিজুর রহমান (৩৫), পিতা-মৃত আব্দুল খালেক মিয়া, টাঙ্গাইল সদর, টাঙ্গাইল ও তার সহযোগি ২। রনি আহমেদ ইমন (২৯), পিতা-সৈয়দ রিটন আহমেদ, বকশিগঞ্জ, জামালপুর, ৩। মোঃ জসিম উদ্দিন (৩৫), পিতা-মোঃ ইদ্রিস মিয়া, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪। মোঃ জামাল উদ্দিন (৫০), পিতা-মৃত আব্দুল আজিজ মিয়া, মেঘনা, কুমিল্লা মোহাম্মদপুর এলাকার চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতা ৫। আবুল মাতুব্বর (৪২), পিতা-মোঃ মোকছেদ মাতুব্বর, সদরপুর, ফরিদপুর, ৬। আহম্মদ আলী (৩৫), পিতা-মৃত হায়দার আলী, মোহাম্মদপুর, ডিএমপি, ঢাকা, ৭। মোঃ কামাল (৪০), পিতা-মৃত মোঃ হাবিব, মোহাম্মদপুর, ডিএমপি, ঢাকা, ৮। মোঃ বাপ্পি (২৯), পিতা-মোঃ মোস্তফা, মোহাম্মদপুর, ডিএমপি, ঢাকা, ৯। মোঃ আবিদ হোসেন সনু (৩৮), পিতা-মোঃ জয়নাল আবেদীন @ জানু, মোহাম্মদপুর, ডিএমপি, ঢাকা, ১০। মোঃ রবিন ভূ্ইয়া (২১), পিতা-মোঃ মহিউদ্দিন ভূইয়া, সাং-কয়েতপাড়া, (দেলপাড়া), থানা-রুপগঞ্জ, জেলা-নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও এলাকার চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতা ১১। মোঃ আরিফুল হোসেন (২২), পিতা-জয়মত হোসেন, সাং-হাটখোলা, থানা-ধামুরহাট, জেলা-নওগাঁ, ১২। ইব্রাহিম মিয়া (৪০), পিতা-মৃত নাবালক মিয়া, মুরাদনগর, কুমিল্লা, ১৩। মোঃ সুজন (২৯), পিতা-রফিকুল ইসলাম, পূর্বধলা, নেত্রকোনা, গুলিস্তান এলাকার চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতা ১৪। মোঃ দেলোয়ার (৩৩), পিতা-মৃত আব্দুল খালেক, দেবীদ্বার, কুমিল্লা, ১৫। মোঃ আব্দুর রহমান (১৯), পিতা-মোঃ ফজর আলী, সালথা, ফরিদপুর, ১৬। মোঃ রাজু (২৭), পিতা-মৃত ইকবাল মাসুদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর, ১৭। মোঃ জিহাদ হোসেন (২৪), পিতা-মনির হোসেন, লালমোহন, ভোলা, ১৮। মোঃ মুনাইম (৩৮), পিতা-আলী অঞ্জন, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯। মোঃ রাজু (৪৫), পিতা-মৃত ইউসুফ, বংশাল, ডিএমপি, ঢাকা, ২০। রফিক (৩৮), পিতা-মৃত আব্দুর রশিদ, ডেমরা, ডিএমপি, ঢাকা’দেরকে গ্রেফতার করে। উদ্ধার করা হয় ৫৪২টি স্মার্ট মোবাইল ফোন, ৩৪১টি বাটন মোবাইল ফোন, বিপুল পরিমাণ ভুয়া আইএমইআই স্টিকার, ০১টি হিটগান, ইলেকট্রনিক সেন্সর ডিভাইস, আইএমইআই পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন টুলস, ছিনতাই এর কাজে ব্যবহৃত ০৬টি চাকু, ০১টি ল্যাপটপ, ০১টি এলসিডি মনিটর এবং নগদ ১১,৬০০/- টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা মোবাইল চোরাকারবারি চক্রের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, তারা মূলত ৪টি চক্রে বিভক্ত হয়ে দীর্ঘ ৫-৬ বছর যাবৎ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এসকল মোবাইল চোরাকারবারির সাথে জড়িত রয়েছে। তারা মোবাইল চুরি, ছিনতাই ও আইএমইআই পরিবর্তনের কারিগর। চক্রটি চোরাইকৃত মোবাইল ফোনগুলো বিক্রির জন্য বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করে থাকে। গ্রেফতারকৃত আব্দুর রহমান, রবিন ভূইয়া ও হাফিজুর রহমান মোবাইল ছিনতাই করে পরবর্তীতে চক্রের মূলহোতা রাজু, সুজন ও আবুল মাতুব্বরসহ অন্যান্যদের নিকট স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দেয়। এছাড়াও তারা অন্যান্য ছিনতাইকারির নিকট থেকে ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন স্বল্প মূল্যে ক্রয় করে থাকে। গ্রেফতারকৃত দেলোয়ার এবং আবুল মাতুব্বর মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর। তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনগুলোর আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করে।
গ্রেফতারকৃত দেলোয়ারের নেতৃত্বাধীন চক্রটি গুলিস্তান এলাকায় সক্রিয়। এ চক্রের নিকট হতে ২৯১টি স্মার্ট ফোন এবং ১৭৯টি বাটন ফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আরিফুলের নেতৃত্বাধীন চক্রটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় সক্রিয়। এ চক্রের নিকট হতে ১০৬টি স্মার্ট ফোন এবং ৫৯টি বাটন ফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আবুল মাতুব্বর নেতৃত্বাধীন চক্রটি মোহাম্মদপুর এলাকায় সক্রিয়। এ চক্রের নিকট হতে ৯১টি স্মার্ট ফোন এবং ২৪টি বাটন ফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত ইমনের নেতৃত্বাধীন চক্রটি খিলগাঁও এলাকায় সক্রিয়। এ চক্রের নিকট হতে ৫৪টি স্মার্ট ফোন এবং ৭৯টি বাটন ফোন উদ্ধার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, চুরি ও ছিনতাইকৃত মোবাইল বিক্রির সময় তারা ক্রেতাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে আইএমইআই পরিবর্তনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। পাশাপাশি তারা মোবাইলের কেসিন, ডিসপ্লেও পরিবর্তন করে ফেলে। গ্রেফতারকৃতরা নিজেরা সকলেই চোরাইকৃত মোবাইলের পরিবর্তিত আইএমইআই নম্বরের ফোন সেট ব্যবহার করে থাকে। গ্রেফতারকৃত এই চক্র ২০ হাজারের অধিক মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রি করেছে বলে জানায়। ব্রান্ড এবং কোয়ালিটি ভেদে এসব মোবাইলের দাম ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভালো মানের মোবাইলগুলো তারা মোবাইল মেরামত করার দোকানে বিক্রি করে থাকে। অন্যান্য মোবাইল ফোনগুলো বিভিন্ন মার্কেটের সম্মুখে ভ্রাম্যমান টেবিলে করে বিক্রয় করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই সকল ফোন বিভিন্ন অপরাধীরা ক্রয় করে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধকর্মে ব্যবহার করে পরবর্তীতে ফেলে দেয়।
গ্রেফতারকৃত দেলোয়ার এর বিরুদ্ধে রাজধানীর বংশাল, শাহবাগ এবং কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। দেলোয়ারের সহযোগী রাজু এবং জিহাদ এর বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়াও গ্রেফতারকৃত অপর মূলহোতা আরিফুল এর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানায় মামলা রয়েছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে মোনায়েম, রফিক ও আরিফুল ইতোপূর্বে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে পরবর্তীতে জামিনে মুক্ত হয়ে আবারো পূর্বের পেশায় লিপ্ত হয়।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।