রেজাউর রহমান রিজভী ।। দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী ও তার পুত্র নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরীর মোট আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এর মধ্যে ২টি গ্রন্থ লিখেছেন আব্দুর রউফ চৌধুরী।
সেগুলো হলো-
‘গল্পসভার’ (আদিত্য প্রকাশ): দশটি ভিন্নস্বাদের ছোটগল্প। দাম্পত্যজীবনের জটিলতা : ‘বিকল্প’ এবং ‘বন্ধুপত্নী’; সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবাদ : ‘ভূত ছাড়ানো’ এবং ‘জিনা’; মনস্তাত্ত্বিক : ‘পরিচয়’ ও ‘শাদি’; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : ‘বীরাঙ্গনা’ এবং ‘বাহাদুর বাঙালি’; বাৎসল্য রস : ‘যৌতুক’ এবং ‘ট্যাকরা-ট্যুকরি’। ভৌগোলিক স্থান যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ। ভৌগোলিক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও একজনের ভালোবাসা, সুখদুঃখ, হাসিকান্না– সবই এক, রক্তের রং-ও এক; কাজেই একটি বিশাল ক্যানভাসে মানুষের গল্প চিত্রিত হয়েছে।
‘একটি জাতিকে হত্যা’ (আদিত্য প্রকাশ): উপজীব্য বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসক ও সমরনায়ক গোষ্ঠী কর্তৃক ১৯৭১-এর হত্যাযজ্ঞ ও গণহত্যা। এসম্বন্ধে বিদেশি পত্রপত্রিকার দুষ্প্রাপ্য কিছু প্রতিবেদনের কখনও হুবহু অনুবাদ, কখনও বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা এই গ্রন্থে যুক্ত করা হয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা-গবেষণার ক্ষেত্রে লেখকের পারঙ্গমতা প্রশ্নাতীত। তাঁর অভিজ্ঞতা, তথ্যসংগ্রহ ও বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা এই গ্রন্থটির মর্যাদাকে অন্যস্তরে উন্নীত করেছে। এখানেই ‘একটি জাতিকে হত্যা’ গ্রন্থটির অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব।
এছাড়া অপর ছয়টি গ্রন্থ লিখেছেন নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরী। সেগুলো হলো-
‘জার্মানি : অতীত ও বর্তমান’ (আগামী প্রকাশনী): এই গ্রন্থে বিশদভাবে জার্মানির সুদীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, কূটনীতি, আর্থসামাজিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে। সমগ্রভাবে জার্মানির বিবর্তনের ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে এই গ্রন্থটি একটি উল্লেখযোগ্য ও চমকপ্রদ দলিল।
‘জার্মান সাহিত্য : প্রারম্ভ থেকে অধুনা’ (আদিত্য প্রকাশ): এই গ্রন্থটি জার্মান সৃজনশীল চিন্তাধারার এক পরিপূর্ণ ইতিহাস। সপ্তম শতকে রচিত হিলডেব্রানডের কীর্তন থেকে শুরু করে উচ্চজার্মান ও ব্যারোক যুগ হয়ে ক্যানট, লেসিং, ক্লোপস্টক, হারডার, ক্লিংগার (তুফান ও তাড়ন), ভাগনার, গ্যেটে, শিলার, ফিশচে, নোভালিশ, ক্লাইস্ট, কার্ল মার্কস, কাফকা, ম্যান, ব্রেশট, রেমার্ক, গ্রাস, মুলার প্রমুখ কথাসাহিত্যিক, কবি, দার্শনিকের রচনার নিদর্শন এই গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে। জার্মান সাহিত্যের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য, মানবিকতাবোধ, সমাজব্যবস্থার আলোচনা-সমালোচনা– কখনও উগ্র, কখনও-বা বৈপ্লবিক; ন্যায়পরায়ণতা ও গণতান্ত্রিক প্রত্যয়, পুঁজিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা– সামগ্রিকভাবে এই স্বাতন্ত্র্য, অভিনব ও তথ্যপূর্ণ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।
নাট্যোপন্যাস ‘যোদ্ধা’ (আদিত্য প্রকাশ): ময়নামতির (ত্রিপুরা) সুপ্রতীক মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য। হঠাৎ তার রাজকোষে এক লাখ মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে। তখন তিনি খোয়াই নরপতির কাছে এক লাখ মুদ্রা ধার চান। কিন্তু খোয়াই নরপতি ধার দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে মহারাজ অপমান করেন। এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই শুরু হয় যুদ্ধ। ত্রিপুরার সেনাপতি মহাবীর ভরতের কাছে পরাজিত হয়ে নিহত হন খোয়াই নরপতি। ভরত নতুন খোয়াই নরপতি হয়। আর বীরশ্রেষ্ঠ শশীভূষণকে করার হয় সেনাবাহিনীর সেনাধ্যক্ষ। কিন্তু ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করার জন্য ভরত ষড়যন্ত্র শুরু করে। শুরু হয় একের পর এক হত্যা। শশীভূষণ ত্রিপুরাকে রক্ষার জন্য ভরতের মুখোমুখী হয়। তরবারি রক্তে রঞ্জিত হয়। পাপাচার ও তার পরিণামের এক মর্মবিদারী বিষয়ই যোদ্ধা নাট্যোপন্যাসের মূল উপজীব্য। একজন মানুষের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে যে-জীবন স্থাপিত হয় তা অবশেষে তাকেই নিক্ষেপ করে অন্ধকার মৃত্যুকূপে।
কবিতাসম্ভার ‘অনাহূত অতিথি’ (আদিত্য প্রকাশ): ‘অনাহূত অতিথি‘ মা-মাটি-মানুষের এক অশ্রুসিক্ত লবণাক্ত ছবি। কখনও দিনবদল বা কালবদলের পূর্বাভাস; কখনও সমাজবদলের প্রস্তুতি আর ঝড়ের দুরন্ত আনাগোনা; কখনও যন্ত্রণাবিদ্ধ সহস্র হৃদয়ের আর্তনাদ; স্বপ্ন-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মন্ত্রণা; হত্যা-সন্ত্রাস-আন্দোলন-ধর্মঘট– রাজনৈতিক ঘটনা আর ধর্মীয় উন্মাদনায় উত্তাল জনজীবন– এইসব নিয়েই ‘অনাহূত অতিথি‘। একটা সময়কে, একটা দেশকে, একটা সমাজকে একদল মানুষকে বুঝে নিতে হলে অনাহূত অতিথির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়।
তিনটি নাটক ‘ত্রয়ী’ (আদিত্য প্রকাশ): তিনটি নাটক : ‘যোদ্ধা’, ‘কলকাতায় গির্জা গালিব’ ও ‘আটই ফাল্গুন‘। যোদ্ধা : ময়নামতির (ত্রিপুরা) ইতিহাসাশ্রয়ী একটি বিয়োগান্ত নাটক, কল্পনাও। মানুষের ভেতরের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কীভাবে অবচেতন চিন্তায় কুমন্ত্রণা দেয়, কীভাবে মানুষের ভেতরের গোপন বাসনাকে কালসাপের মতো উন্মাদ করে তোলে, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সমস্ত বিবেক বিসর্জন দিয়ে আপন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অবশেষে নৃশংস হত্যা ও পাপকর্মের পরিণামস্বরূপ এই মানুষ নামের জীবটিরও মৃত্যু ঘটে শোচনীয়ভাবে। কলকাতায় গির্জা গালিব : একটি বিয়োগান্তক নাটক। গালিব তখন যুবক। কলকাতায় এসেছেন কয়েক বছরের জন্য। এখানেই তাঁর একজন বাঈজির সঙ্গে মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়। ভালোবাসা, মায়া, মমতা, দুঃখ, যন্ত্রণা নিভৃতে ভাষা পায়। হঠাৎ বাঈজি কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। গালিবও কলকাতা ত্যাগ করেন, যা অনিবার্য পরিণতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ণয় করে। আটই ফাল্গুন : এই নাটকের প্রধান চরিত্র আম্মা। তিনি একজন ভাষাসৈনিক। তিনি দুর্লভ এক নারী। কালকে অতিক্রম করে যান, একইসঙ্গে এগিয়ে দেন প্রবহমাণ কালের ধারাকেও, যে-ধারা মাঝেমধ্যে স্তিমিত হয়, নিস্তরঙ্গ হয়। তিনি লাঞ্ছিত হন, উপহসিত হন, বিরক্তিভাজন হন। অতীত-হারানো ও ঠিকানা খুঁজে-ফেরা আম্মার বুক-ফাটা যন্ত্রণা ও হাহাকারের এক হৃদয়স্পর্শী অজানিতি একটি আলেখ্য।
‘মগ্নপাঠ : সুরা বাকারাহ’ (আদিত্য প্রকাশ): ধর্মগ্রন্থ হিসেবে আল-কুরআনের বাণী চিরন্তন– সর্বজ্ঞানসম্পন্ন; কিন্তু যুগে যুগে আল-কুরআনের মগ্নপাঠের প্রয়োজন রয়েই যায়; কারণ, আরবি ও বাংলা ভাষার বাক্যগঠনরীতি, বাক্ভঙ্গি, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক ব্যবহারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাছাড়া আল-কুরআনের ভাষা ধ্রুপদী আরবি, বচনবিন্যাসপ্রণালি নিপুণ, শব্দ অমৃতকণা, অলংকার– মাধুর্য মধুরতায় ভরপুর, অনুপমেয়। ফলে আক্ষরিক বঙ্গানুবাদে আল-কুরআনের নিদর্শনসমূহের মর্মার্থে পৌঁছানো কঠিন। তবে আল-কুরআনে বারবার তার নিদর্শনসমূহের অর্থ উপলব্ধি এবং হৃদয়ঙ্গম করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই এই মহাগ্রন্থের একটি অধ্যায়ের (সুরার) মূলানুগ মগ্নপাঠের চেষ্টা করা হয়েছে।