নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্বজুড়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণকে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে স্বর্ণের মূল্য সাধারণত ঊর্ধ্বমুখী থাকে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বাংলাদেশেও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বর্ণ ধারাবাহিকভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তবে স্বর্ণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা মাধ্যম রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের ভিন্ন সুযোগ ও সুবিধা প্রদান করে।
চকচক করলেই সোনা হয় না, তা ঠিক। কিন্তু এটাও সত্য, চলতি বছর সোনার দাম বাড়ছে। এ বছর রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে সোনা। ফলে সোনার চকচকে ভাব আরও বেড়েছে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে সোনার। এমনকি চলতি সপ্তাহে বিশ্ববাজারে সোনার দাম সর্বকালীন রেকর্ড আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৭৪৮ ডলারে উঠে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোনায় বিনিয়োগের বিভিন্ন মাধ্যম আছে দেখে নেওয়া যাক, সোনায় বিনিয়োগের মাধ্যমগুলো কী কী। খবর সিএনএন
প্রথম প্রথম যাঁরা সোনা কিনবেন, তাঁদের জন্য বিশ্লেষকদের পরামর্শ হলো, কী উদ্দেশ্যে সোনা কেনা, তা ঠিক করা। এটা কি আপনার বিনিয়োগ বহুমুখী করার লক্ষ্যে, নাকি নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে তা ঠিক করা।
এরপরের প্রশ্ন হলো, কীরূপে সোনা কেনা হবে। উন্নত দেশে অবশ্য সুযোগ আছে, বিনিয়োগ হিসেবে কেউ সোনা কিনতে চাইলে গোল্ড ব্যাকড এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করা যায়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর শেয়ার ব্রোকারসহ ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট বা হিসাবের প্রয়োজন হয়; প্রয়োজন পড়ে ডিম্যাট (অনলাইন পোর্টফোলিও) হিসাবের। এই প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা খুব সামান্য পরিমাণ সোনাতেও বিনিয়োগ করতে পারেন। ইটিএফে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা মাশুলের প্রয়োজন হয় না।
সোনায় বিনিয়োগের আরেকটি মাধ্যম হলো ডিজিটাল সোনা। অনেক দেশে সোনার দোকান ও বিনিয়োগকারী সংস্থার অনলাইন সাইট থেকে ডিজিটাল সোনা কেনা যায়। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাকে মজুরি দিতে হয় না ও সোনা খাঁটি কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে না। এত সুবিধা হলো কোথায় সোনা রাখা হবে, তা নিয়েও ভাবতে হয় না। প্রতি মাসে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে এই ডিজিটাল সোনা কেনা যায়।
কোনো কোনো দেশে গোল্ড বন্ডও আছে। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা হাতে সোনা না পেলেও সোনায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। এই বন্ডের মেয়াদ ও সুদহার নির্ধারণ করা থাকে। মেয়াদের আগেও কেউ এই বন্ড ভেঙে ফেলতে পারেন। বিনিয়োগের দিক থেকে এই পদ্ধতি বেশ সুরক্ষিত।
প্রথাগত গয়না কেনার পাশাপাশি সোনার কয়েন বা বার কেনা যায়। সে ক্ষেত্রে হলমার্ক চিহ্ন যাচাই করে সোনা কিনতে হয়।
সরাসরি সোনা কেনার সময় এটাও ভেবে দেখা উচিত, এই সোনা আবার বিক্রি করতে হতে পারে। সে জন্য কোথা থেকে সেই সোনা কেনা হচ্ছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য বিশ্লেষকদের পরামর্শ, বিশ্বাসযোগ্য জায়গা থেকে সোনা কেনা উচিত।
যেসব কারণে চলতি বছর সোনার দাম বেড়েছে, তার মধ্যে আছে ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা। ভারত ও চীনের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার-নির্ভরতা হ্রাসও সোনার মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা দোকান কস্টকো এক আউন্সের বুলিয়ন বার বাজারে ছাড়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পক্ষে আর ১০টা পণ্য কেনার মতো সোনার বার কেনাও সহজ হয়েছে। ফলে সোনার পালে রীতিমতো হাওয়া লেগেছে। এই প্রবণতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। অতীতেও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা গেছে।
স্বর্ণ কেনার মূল প্রণোদনা হলো মানুষ মনে করে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় স্টক, বন্ড বা মুদ্রার তুলনায় সোনা থেকে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। অর্থনীতি নিম্নমুখী হলে সোনা প্রকৃত অর্থেই সোনা ফলাবে।
২০০৮ থেকে ২০১২ সাল অর্থাৎ পশ্চিমা পৃথিবীতে আর্থিক মন্দার সময় সোনার দাম নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যানুসারে, সোনার প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্স বা পিপিআইয়ের মান এই সময় ১০১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছিল। ওই সময় অনিশ্চয়তা ছিল তুঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে তখন সোনার দাম বেড়েছে।
সোনার দাম বাড়ার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির বিশেষ সম্পর্ক নেই বলেই গবেষকেরা মনে করেন। সোনার দাম বাড়ার মূল কারণ হলো ভয় ও আতঙ্ক। সেই ১৯৩০ সালের মহামন্দার সময় থেকেই দেখা যাচ্ছে, সংকট এলেই সোনার দাম বাড়ে। গোল্ড প্রাইস ডটকমের তথ্যানুসারে, ১৯৭০ সালের সংকটের সময় সোনার দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলার হয়েছিল; ১৯৮০ সালে সেই দর হয় ৬১৫ ডলার। ১৯৯০ সালে সেটি অনেক কমে ৩৮৩ ডলারে নেমেছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালে আবার অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার পর ২০১১ সালে সোনার দর অনেকটা বেড়ে যায়; তখন দাম ওঠে ১ হাজার ৯০০ ডলারে। অবশ্য ২০১৫ সালের দিকে সোনার দাম ১ হাজার ৪৯ ডলারে নেমে এলেও বেশি দিন সেই দামে থাকেনি। এর পর থেকে দাম কেবল বেড়েছেই।