নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুনকে তার সাবেক স্বামী হারুন-অর রশিদের পরিকল্পনায় অপহরণ করে গাড়িচালক মাসুদ।
শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। এরআগে শুক্রবার দিবাগত রাতে মাসুদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
খন্দকার আল মঈন বলেন, অপহরণের শিকার এই যুগ্ম কমিশনারের সাবেক স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হারুন-অর রশিদ। হারুনের রাগ-ক্ষোভ ছিল তার স্ত্রীর ওপর।
র্যাব বলছে, সেই ক্ষোভ থেকেই মাসুমাকে অপহরণের পরিকল্পনা করেন হারুন। পরিকল্পনায় ব্যবহার করা হয় মাসুমার সাবেক গাড়িচালক মাসুদকে। মাসুদের নেতৃত্বে অপহরণ মিশনে অংশ নেয় মোট সাতজন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন ৫০ হাজার টাকায় হাতিরঝিল এলাকায় একটি বাসা নেন। তবে অহপরণের পর মাসুমাকে ওই বাসায় নেওয়া সম্ভব হয় না। এর বদলে তাকে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকার একটি গ্যারেজে। সেখানে গাড়িতেই মাসুমাকে ব্যাপক মারধর করা হয়। পর দিন তাকে নেওয়া হয় মাদারটেক এলাকায়। সেখানে তার চিৎকারে এলাকাবাসীর হাতে আটক হন তিনজন। পালিয়ে যান মাসুদসহ চারজন।
ওই নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপহরণ ও নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় রমনা থানায় মামলাও দায়ের হয়েছে। এতে প্রধান আসামি করা হয় মাসুম ওরফে মাসুদকে।
মাসুদ ছাড়াও শুক্রবার আরও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন- আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনি (৪৮)।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার মাসুদ জানায়, তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে তিনি মাসুমা খাতুনের সাবেক স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর মাসুমাকে উচিত শিক্ষা দিতে মাসুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেন হারুন। এরজন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান তিনি। মাসুদকে অগ্রিম ৭০ হাজার টাকাও দেন হারুন।
১৫ আগস্ট সবুজবাগে মাসুদ তার পরিচিতি হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানান এবং সবাইকে টাকার ভাগ দেন। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে মাসুমা খাতুনকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেন। মাসুমার বর্তমান গাড়ি চালকের সাথে গ্রেপ্তার হওয়া হাফিজের সুসম্পর্ক ছিল। এ সুবাদে তার থেকে তথ্য নিয়ে মাসুদকে জানান হাফিজ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মাসুদ ও তার সহযোগীরা ১৭ আগস্ট রাত ৮টার দিকে বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেন। মাসুমা খাতুন রাত সোয়া ৮টার দিকে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে গাড়ির গতিরোধ করা হয়। এ সময় মাসুমার গাড়িচালক মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য গাড়ি থেকে নামলে তাকে মারধর করা হয় এবং মাসুদ গাড়িতে উঠে পড়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেন ও সহযোগীদের নিয়ে মাসুমা খাতুনকে অপহরণ করে হাতিরঝিলের দিকে চলে যান।
গ্রেপ্তার মাসুদ র্যাবকে আরও জানিয়েছে, অপহরণের পরই বিষয়টি হারুনকে জানানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাসুমাকে হাতিরঝিলের একটি বাসায় নেওয়ার কথা থাকলেও ওই বাসার মেইন গেট বন্ধ পাওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরতে থাকেন তারা। এরপর রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় পরিচিত একটি গ্যারেজে গাড়িটি ঢোকানো হয়।
সেখানে নেওয়ার পথে অপহৃত নারীকে নির্যাতন করা হয়, প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
পরদিন ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাড়িটি নিয়ে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যান মাসুদ। সেখানে জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করেন। দুপুরে খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যান এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি পাহাড়া দিচ্ছিলেন। এ সময় সুযোগ বুঝে ওই নারী চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করেন। মাসুদ, পনু ও শান্ত পালিয়ে যান।
গ্রেপ্তার মাসুদ সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, ২৫ বছর ধরে পেশায় গাড়িচালক মাসুদ আগে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালিয়েছেন। একটি দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্স বাতিল হয়। এ ছাড়াও তিনি গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরণের অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন।
গ্রেপ্তার পনু পেশায় সিএনজি চালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার মাসুদ তাকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করেন।
গ্রেপ্তার হাফিজ দূরপাল্লার বাস চালক। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে গ্রেপ্তার মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা।
নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক স্বামী হারুন কোথায়? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি মগবাজারের বাসাতেই অবস্থান করছেন বলে জেনেছি।
অপহরণে তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েও কেন এখনও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি? জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানলে জানতে পারে। হারুনের নাম মামলার এজহারে নেই। যে কারণে প্রাপ্ত তথ্য তদন্ত সংস্থাকে জানানো হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই দিন বড় মগবাজার থেকে নিজের গাড়িতে করে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ফিরছিলেন মাসুমা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পৌঁছালে তাদের গাড়িতে একটি মোটরসাইকেল গিয়ে ধাক্কা দেয়। চালক গাড়ি থেকে নামলে সংঘবদ্ধ কয়েকজন চাবি কেড়ে নিয়ে গাড়িচালক আনোয়ার ও মাসুমাকে মারধর শুরু করে। এরপর আনোয়ারকে রেখে মাসুমা ও তার গাড়ি সবুজবাগের একটি গ্যারেজে নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। মাসুমার মুখ টেপ দিয়ে আটকে রাতভর মারধর করা হয়। পর দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত তাকে আটকে রেখে নির্যাতন চলে।
উল্লেখ্য, গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এ নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে এবং তিন অপহরণকারীকে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী।
এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট ভুক্তভোগী বাদী হয়ে তার সাবেক গাড়িচালক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
এরপর র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারিতে শুক্রবার রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এই অপহরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া এক মামলার প্রধান আসামি মাসুদ এবং তার সহযোগী মো. আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহীনকে (৪৮) গ্রেপ্তার করে র্যাব।