নববর্ষ, অর্থাৎ নতুন বছর। আর যেকোনো নতুনকে বরণ করা বাঙালি সংস্কৃতির একটি চিরায়ত আচার। সেখানে ১ বৈশাখ হলে তো কথাই নেই। আজ সেই ক্ষণ। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার। আমরাও কার্পণ্য করিনি। এসেছে নতুন বছর।
আমাদের সন বাংলা, মাস বাংলা কিন্তু চলন ইংরেজি ধারায়। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আজ বাংলা সনের কত তারিখ। তিনি নিশ্চয়ই আপনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবেন। তারিখ তো দূরের কথা কত সন সেটাই বলতে পারবেন না। কিন্তু এরা সবাই আবার বর্ষবরণ পালন করেন এবং তা বেশ দাপটের সঙ্গে। ব্যাপারটা স্ববিরোধিতায় পূর্ণ। অথবা তাকে আমরা আত্মপ্রবঞ্চক হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।
আমরা বাংলা সন অনুযায়ী চলি না, বলি না এবং কোনো কাজও করি না। অথচ আমরা এসো হে বৈশাখ এসো হে… আকাশ-বাতাস মুখরিত করে স্লোগানে গাইতে থাকি। সর্বত্রই যেন ভালোবাসার ঘাটতি খুঁজে পাওয়া যায়। মনে হয় সবটাই যেন লোক দেখানো। হঠাৎ কারো কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, বাংলা নববর্ষ কবে? ওপাশ থেকে জবাবটা আসবে এ রকম : কেন ১৪ এপ্রিল। পহেলা বৈশাখ যে নববর্ষ তা আর স্মৃতিতে থাকে না। মননে না থাকলে স্মৃতিতে থাকিবে কেমনে! কারণ বাংলা মাস বাঙালি জীবনে আজ অনেকটাই মৃত। আইসিইউ বা সিসিইউতে শুয়ে আছে দীর্ঘদিন। বাংলা তারিখের মৃত্যু না হলেও প্রায় মৃত বললেও বেশি বলা হবে না। আমরা শুধু এখন লোক-দেখানো এক দিনের উৎসববৃত্তে আটকে গেছি।
বাঙালির জন্য এই দিনটা অনেক আনন্দের, অনেক উৎসবের এটা অবশ্যই স্বীকার করতেই হয়। দিনটা বাঙালি জাতির পরিচয় লালন করার জন্য এক মাহেন্দ্রক্ষণ। বলা যায় এটা বাঙালির শরীরে প্রবাহিত শিরা-উপশিরার উসংহার। কিন্তু আমরা যেভাবে এগোচ্ছি তাতে এক দিন এই দিনটিও অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমরা বাংলাচর্চা করি, তবে সে চর্চার মধ্যে ভালোবাসা থাকে না। কিন্তু ইংরেজি শেখার জন্য শুধু ভালোবাসাই দিই না অনেক-অনেক টাকাও খরচ করে ফেলি। আমরা ইংরেজি শিখতে শিখতে এমন হয়ে পড়েছি বাংলায় আবার ইংরেজিও মেশাতে শুরু করেছি। আর যারা বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশ্রণ করে কথা বলেন, সমাজ তাদেরই আধুনিক বলে গণ্য করে। কিন্তু কেন?
এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা জানি অর্থনীতিই সবকিছুর চালিকাশক্তি। আর সে কারণেই দমন, পীড়ন, আগ্রাসন, প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক সময় ও পরিবেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিই নিয়ন্ত্রণ করে ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। তাই বাংলা সন বা নববর্ষ যেন আজ করুণাশ্রিত। কতিপয় পোশাকধারী বাঙালির করুণায় বেঁচে আছে- বেঁচে ওঠে একটি দিনের জন্য। আজ সেই দিন- পহেলা বৈশাখ।
এবার আসা যাক পহেলা বৈশাখ নিয়ে। এটাই আমাদের বছরের প্রথম দিন। অনেকেই বলেন, আমরা তো নতুন বছরে পদার্পণ করেছি। পদার্পণ করেছি সত্য কিন্তু আলিঙ্গন করতে পারিনি। বাহ্যত আলিঙ্গনের যেটুকু দেখা যায় তা যেন নাটকের দৃশ্য বৈ অন্য কিছু নয়। যদিও পহেলা বৈশাখ আমাদেরই নতুন বছরের প্রথম দিবস। তাই সারা বছরের সব জীর্ণতা ক্লান্তি দূর করে পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে স্বপ্নে আঁকা
একটি ভবিষ্যৎ। পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধ। সম্ভবত তা গণমাধ্যমের ক্যামেরা এবং ব্যস্ত নগরে।
তবে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশ-বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালি এই দিন নিজ সংস্কৃতিতে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে। তাও আবার একটি দিনের ১৬টি ঘণ্টার বৃত্তে। যদিও পহেলা বৈশাখ হতে পারত প্রতিটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেও শুধু এক দিনের একটি উৎসব থেকে এখনো সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য এ দেশের মানুষ সব সময়ই আন্তরিক, অকৃত্রিম ও অগ্রগামী। তবু কোথায় যেন বাধা। নিজের মতো করে এগিয়ে যেতে পারেনি কখনো। দীর্ঘ প্রস্তুতির বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অনেক আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। প্রশ্ন থেকেই যায়, শতকরা হিসাবে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা কত!
নগরকেন্দ্রিক ব্যস্ততাকে পিছে ফেলে নগরের সমস্ত শ্রেণিপেশার মানুষ এই দিনটিকে সাদরে বরণ করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা সব অপসংস্কৃতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাঙালি সংস্কৃতির জন্য যা ছিল একটি বিশাল অর্জন। এ ছাড়া রমনার বটমূলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় সংগীত, নৃত্যকলা কিংবা আবৃতি। এই শিল্পগুলোর প্রতিটিই স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়কে। বরণ করে নেয় নিজ পরিচয়ের নববর্ষকে।
নববর্ষের এই উৎসব নারী-পুরুষ সবার। উৎসবে যোগ দেওয়ার স্বাধীনতাও সবার সমান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নারী হয়রানি এবং নির্যাতনের বিষয়গুলো লক্ষ করা যাচ্ছে উদযাপনকালে, উৎসবস্থলে। এটি আমরা মেনে নেব না। এবারের নববর্ষের শুভক্ষণে মুছে যাক বিগত বছরের জরা এবং গ্লানি, যার মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন এবং আগুনের ঘটনাগুলো। সবার প্রতি আহ্বান, যার যার অবস্থান থেকে, বছরের প্রথম দিনটি থেকেই সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধে দাঁড়াব- এটাই হোক বাংলা নববর্ষের শপথ।
একটি জাতি যখন তার নিজ সংস্কৃতিতে বলিষ্ট হয় তখন তাকে কোনো অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার গ্রাস করতে পারে না। তাই নিজ সংস্কৃতির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা শিল্পগুলোর নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। যেকোনো জাতির কাছেই তার নিজ সংস্কৃতিই সেরা এবং আপন। বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেদের সংস্কৃতির রক্ষায় এবং বিস্তারে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ছায়াতলে অবস্থান নিতে হবে। অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গেও আমরা পরিচিত হব, তবে তার আড়ালে যেন ঢেকে না যায় আমাদের স্বকীয়তা। কিন্তু বর্তমানে আমরা যেন সে পথেই হাঁটছি। বাঙালি হিসেবে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকাও জরুরি। অন্যথায় পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি কিংবা বাঙালির যেকোনো উৎসব হবে অর্থহীন। বাঙালির প্রাণ পহেলা বৈশাখকে আরো অর্থবহ করতে হলে প্রয়োজন বাঙালির স্বকীয়তা ধরে রাখা। তবেই জাগ্রত হবে বাংলার নববর্ষ এবং বাঙালির সংস্কৃতি।
লেখক : আজহার মাহমুদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।