নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর তালিকাভুক্ত দুই কোম্পানি বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এবং পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড মানছেনা বিএসইসির নির্দেশনা। বিশেষ পর্যবেক্ষনে জানা যায় একই ব্যাক্তি এক সাথে দুই কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন। এমনকি দুই কোম্পানির ফ্যাক্টরি ও অফিসের ঠিকানাও একই।
গত বছর (২০ ডিসেম্বর ২০২০) দেশের পুঁজিবাজারে ওভার-দ্যা কাউন্টার (ওটিসি) মার্কেটের তালিকাধীন ২১ কোম্পানির আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে উপযুক্ত কর্ম পরিকল্পনা দাখিলের নির্দেশ দিয়োছলো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একইসঙ্গে আর্থিক অবস্থার তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কোম্পানিগুলোর আরও ১১ টির বিষয়ে তথ্য চেয়ে পরিচালনা পর্ষদ, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ও কোম্পানি সচিবকে শুনানির জন্য তলব করেছে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এর আগে ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে বিভিন্ন খাতের ৬৬টি কোম্পানিকে মার্কেট থেকে সরিয়ে (ওভার দ্য কাউন্টার) ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এবং বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড। তবে মুনাফায় ফেরার পাশাপাশি সুশাসনে উন্নতি করায় গত ১৩ জুন ওটিসি মার্কেট থেকে এই কোম্পানিসহ চারটি কোম্পানিকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনা হয়। এসেই কারসাজি শুরু করেছে কোম্পানি গুলো। হঠাতি শেয়ার দাম বাড়তে থাকে কোম্পানিগুলোর ।
গত একবছরে বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এর শেয়ার দর ওঠানামা করে সর্বনিম্ন ৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২৪৯.৮০ টাকা। অপরদিকে গত এক বছরে পেপার প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং এর শেয়ার দর ওঠানামা করে সর্বনিম্ন ১৭.৬০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২৪৭ টাকা।
বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমান ৫০ কোটি টাকা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ৯ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৯৩ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা ৮২৫ টি। তার মধ্যে তারমধ্যে ৫৩.৮৩ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ০.৩৫ শতাংশ এবং বাকি ৪৫.৮২ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।
অপরদিকে পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমান ২৫ কোটি টাকা। কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার ১ কোটি ৪ লক্ষ ৪৯ হাজার টাকা ৬০০ টি। তারমধ্যে ৪৩.৯৬ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ০.৫৪ শতাংশ এবং বাকি ৫৫.৫০ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।
বার বার নোটিশ করার পরও কোম্পানি দুটোর কিছু দিকেই খেয়ালিপনা রয়েই গেছে। ডিএসইতে কোম্পানি দুটির প্রফাইলে দেওয়া নেই কোন কোম্পানি সেক্রটারির নাম, মোবাইল নাম্বার। তারমধ্যে পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এর ওয়েবসাইটের কোন তথ্য দেওয়া নেই।
১৯৮৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড। এবং ১৯৯০ সালে তালিকাভুক্ত হয় পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডে। এই কোম্পানি দুটির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন।
বিশেষ পর্যবেক্ষন করে দেখা গেছে, কোম্পানি দুটির নেই কোন সুশাসন। তাদের কোম্পানি সচিব, সিএফও, হেড অফ ইন্টার্নাল অডিট, ফ্যাক্টরি ও অফিসের ঠিকানাও একই।
এ বিষয়ে ডিএসইর হেড অফ মার্কেট অপারেশন বিভাগের প্রধান ওয়াসি আজম কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেনা বলে অন্য আরেকজনের ফোন নাম্বার দেন। নাম্বারটিতে ফোন করলে রিসিভ করেনি কেউ।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক মোঃ মিজানুর রহমান, এফসিএস বলেন, “ ডিএসই ও সিএসই এর সঠিক তদারকির অভাবে এসব কোম্পানি বার বার সাধারণ বিনিয়োগকারিদের ঠকাচ্ছে। তিনি আরোও বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রনকারি কর্তৃপক্ষের ঠিলে-ঠালা মনিটরিং ও বিএসইসির উদাসিনতায় পুজিবাজারে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পুঁজিবাজার কখনোই স্বাভাবিক আচরণ করছেনা। আর বাজারে কিছু হলেই নিয়ন্ত্রনকারি কর্তৃপক্ষ তার দায় চাপিয়ে দেন এর ওর ঘারে এবং প্রতারিত হন সাধারন বিনিয়োগকারি”।
উভয় প্রতিষ্ঠানে কোম্পানি সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সিএফও হিসেবে নাইমুল ইসলাম, হেড অফ ইন্ট্রানাল অডিটর মো. সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠান দুটির ফ্যাক্টরি শ্রীরামপুর, ধামরাই দেখানো হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা দেখানো হয়েছে প্লট নং- ৩১৪/এ, রোড নং- ১৮, ব্লক-ই, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা।
এদিকে কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোর্ড (৩ জুন ২০১৮) এর ৩ (১) (সি) ধারায় বলা আছে, কোনও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানি সচিব বা প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা একইসময় অন্য কোনও কোম্পানি, প্রতিষ্ঠানে একই পদে বা অন্য কোনও পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন না।
পুঁজিবাজারে একগুচ্ছ অনিয়ম নিয়েই লেনদেন চালাচ্ছে কোম্পানি দুটি। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার ১৯৮৯ সালে তালিকাভুক্ত হলেও ১৯৯৬ সালে ১:৫ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। এরপর ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ বোনাস দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। সম্প্রতি ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে আসার পর ২০২০ সালে ৯ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ এবং ৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয় কোম্পনিটি
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মনোস্পুল পেপার বছরের পর বছর মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মনোস্পুল পেপারের নিট মুনাফা ছিল তিন কোটি আট লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল তিন কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ২৬১ টাকা; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৬ টাকা; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ২৯৭ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৭৬২ টাকা নিট মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এর তথ্য অনুসারে, দুটো কোম্পানিরই আজকে শেয়ার দর কমেছে। মনোস্পুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড এর আজকের শেয়ার মূল্য হ্রাস পেয়েছে ৩.০৯ শতাংশ। কোম্পানিটির গত কালের ক্লোজিং প্রাইস ছিলো ১৯৪.২০ টাকা। আজকের ওপেনিং প্রাইস ১৯০.৫০ টাকা। এবং ক্লোজিং প্রাইস ১৮৮.২০ টাকা। কোম্পানিটি ৩১৫ বারে ৩০ হাজার ৯৮৪ টি শেয়ার লেনদেন করে । যার বাজার মূল্য ৫৭ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।
পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড এর আজকের শেয়ার মূল্য হ্রাস পেয়েছে ৪.১১ শতাংশ। কোম্পানিটির গত কালের ক্লোজিং প্রাইস ছিলো ২০৬.৮০ টাকা। আজকের ওপেনিং প্রাইস ২০৬.৭০ টাকা। এবং ক্লোজিং প্রাইস ১৯৮.৩০ টাকা। কোম্পানিটি ১ হাজার ৩৭৩ বারে ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩০১ টি শেয়ার লেনদেন করে । যার বাজার মূল্য ৩ কোটি ১১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।