বিনোদন ডেস্ক : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি কাহিনী নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় অপারেশন জ্যাকপট নামের এক অভিযানে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে গেরিলা অপারেশন চালানো হয়েছিল। সেই অভিযানে পাকিস্তান ও অন্য আরও কয়েকটি দেশ থেকে অস্ত্র, খাদ্য ও তেল নিয়ে আসা ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা।
সেই ঘটনা নিয়ে বিশাল বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে কয়েকজন নির্মাতা অভিযোগ করেছেন, যেভাবে দরপত্রের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে এই কাজটি দেয়া হয়েছে, তা যথাযথ হয়নি।
সিনেমা নিয়ে বিতর্ক কেন?
প্রায় আড়াই বছর আগে অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে প্রথম একটি চলচ্চিত্র তৈরির উদ্যোগ নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই সময় তারা চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমকে চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব দেয়। পুরো প্রকল্পের বাজেট ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এরপর থেকে তিনি এ নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাও করেন।
গত বছর এই চলচ্চিত্র নির্মাণ তদারকির দায়িত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছরের অগাস্ট মাসে তারা এই চলচ্চিত্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে। সেই দরপত্রে অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটি পায় ‘কিবরিয়া ফিল্মস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাতে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’ অংশ নিলেও, আবেদন “বিধিসম্মত না হওয়ায়” তাদেরকে বাদ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।
গিয়াসউদ্দিন সেলিম অভিযোগ করেছেন, “নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় প্রথম যখন এই উদ্যোগ নিয়েছে, শুরু থেকেই আমি চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক হিসাবে যুক্ত রয়েছি। এ নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে আমি গবেষণা করছি। এরপর যখন সেটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে আসে, তখনো আমি পরামর্শ দিয়ে আসছি।”
“আমি যে চিত্রনাট্য করেছিলাম, সেটার মূল্যায়নে একটি কমিটিও করেছে মন্ত্রণালয়, যেখানে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, মোরশেদুল ইসলাম এবং জুনায়েদ হালিম রয়েছেন। তাদের সাহায্য করতে আমাকেও রাখা হয়েছিল কমিটিতে। এসব কিছুই তারা করেছেন।”
“এখন তারা বলছে, যেহেতু আমি সেই চিত্রনাট্য কমিটিতে ছিলাম, তাই আমি নাকি পরিচালক হিসাবে থাকতে পারবো না। সেটা নাকি নিয়ম বহির্ভূত হবে। অথচ তারাই (মন্ত্রণালয়) আমাকে এই কাজের জন্য বলেছে। তারা কিন্তু কখনো আমাকে বলেনি যে, এটা হলে ওটা হবে না। অথচ এ নিয়ে আমি বছরের পর বছর ধরে রিসার্চ করেছি, অনেকের সাথে কথা বলেছি।”
গত বছরের মধ্যভাগে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যে দরপত্র আহ্বান করেছিল, তাতে মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। সেখান থেকেই কিবরিয়া ফিল্মকে কাজটি দেয়া হয়। তবে নির্মাতাদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, টাকাপয়সার লেনদেন, দুর্নীতির মাধ্যমে এই কাজটি বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে।
চিত্রনাট্য কমিটির সদস্য মোরশেদুল ইসলাম বলছেন, “এখানে যা হয়েছে, তা হলো দুর্নীতি। অনেক টাকার কাজ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের দেয়া হয়েছে। টাকা পয়সার লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া আর কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।”
“আমরা শুরু থেকেই চিত্রনাট্য কমিটিতে ছিলাম। চারবছর ধরে সেলিমের স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন করেছি। কিন্তু এদের স্ক্রিপ্ট কোন কমিটি মূল্যায়ন করেছে, আদৌ করেছে কি না, তা তো আমরা জানি না। এভাবে তো হতে পারে না। টেন্ডারে লোয়েস্ট বিড দিলেই তো হবে না, তাদের স্ক্রিপ্ট কেমন, তা আমি জানি না। কিন্তু ফিল্ম মেকিং তো টেন্ডারের বিষয় না। তাদের স্ক্রিপ্ট তো মূল্যায়ন হতে হবে,’’ তিনি বলছেন।
তারা আশা করছেন, সরকারের শীর্ষ মহল বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখবে।
কী বলছে মন্ত্রণালয়?
অনিয়ম বা দুর্নীতির যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা অস্বীকার করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ খাজা মিয়া বলছেন, এখানে কোন অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি। সরকার কাজ পাওয়ার বা দেয়ার যেসব বিধিবিধান থাকে, সেগুলো অনুসরণ করেই যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘”এই ধরনের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। সত্যি সত্যি যদি তাদের সেরকম অভিযোগ থাকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তারা সেটা তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু এখানে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। যেকোনো ব্যক্তি তার মতো করে ছবি তৈরি করতে পারেন। কিন্তু সরকারের মাধ্যমে যদি কোন ছবি তৈরি করতে চান, সরকারি অর্থ বিনিয়োগ বা ব্যয় করার তো একটা পদ্ধতি আছে।
‘’সেইসব বিধিবিধান অনুযায়ী সব কাজ করা হয়েছে। তাতে কে পাবে আর কে পাবে না, সেটা তো আগে নির্ধারণ করা যায় না। যারা পাবে না, তারা তো ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে।‘’
তিনি আশা করছেন, টেকনিক্যাল কমিটির যাচাই বাছাইয়ে সব শর্ত পূরণ করে যোগ্যতা প্রমাণ করেই একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। তারা কাজটি ঠিকভাবে করতে পারবে বলে তিনি আশা করছেন।
যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে অপারেশন জ্যাকপটে
কিবরিয়া ফিল্মস সম্ভাব্য পরিচালক হিসাবে তাদের প্রস্তাবে যাদের নাম উল্লেখ করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু (বাংলাদেশ), স্বপন চৌধুরী (বাংলাদেশ), জেপি দত্ত (ভারত) এবং অনিরুদ্ধ রায় (ভারত)।
তবে ছবি নির্মাণ প্রস্তাবের দরপত্রে নাম থাকলেও এটি নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে কিছুই জানতেন না বলে জানিয়েছেন দেলোয়ার জানান ঝণ্টু।
তিনি বলেছেন, ‘’সোজা কথা আমি বলি, অপারেশন জ্যাকপট সিনেমার বিষয়ে এসব আলোচনার আগে আমি কিছুই জানতাম না। একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি প্রথম শুনি, আমাকে না কি পরিচালক হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। তাকে বললাম, আমি তোমার কাছেই প্রথম শুনলাম, আমি তো জানিই না। তখন সে বলল, টেন্ডারে অ্যাপ্লাই করে কিবরিয়া ফিল্ম ছবিটা পেয়েছে।‘’
‘’তখন আমি লিপুকে (গোলাম কিবরিয়া লিপু, কিবরিয়া ফিল্মসের কর্ণধার) টেলিফোন করলাম। বললাম, এই নামে তুমি কি ছবি করার অ্যাপ্লাই করছো? সে বললো, আমিও তো এখনো জানি না। তখন সে খবর নিয়ে দেখে, সে ছবিটা পাইছে।‘’
এই বিষয়ে কিবরিয়া ফিল্মসের কর্ণধার গোলাম কিবরিয়া লিপু বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘’নিয়ম মেনে আমরা টেন্ডারে অংশ নিয়েছিলাম। কাজটা আমরা পেয়েছি, তবে এখন এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।‘’
কিবরিয়া ফিল্মসের প্রস্তাবিত অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রে অভিনয় শিল্পীদের যে তালিকা দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন- শাকিব খান, ওমর সানি, মোশাররফ করিম, মৌসুমি, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, রিয়াজ, নিপুণ, ববিতা, আহমেদ শরীফ, সুচরিতা, মিশা সওদাগর, সুচরিতা, চম্পা, ভারতের রাণী মুখার্জি, সানি দেওল, সুনীল শেঠি, ফারদিন খান, জয়া বচ্চনসহ আরও কয়েকজন।
সূত্র-বিবিসি।