মনির হোসেন, বেনাপোল প্রতিনিধি: দেশের স্থলবন্দরের২৪টি মধ্যে সচল ১৬ বন্দর দিয়ে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬ টন পণ্য। রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১২ লাখ ৭২ হাজার ৩২৮ টন বাংলাদেশি পণ্য। বাণিজ্য উপযোগী অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে না ওঠায় দেশের অন্য ৮টি বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানির চাহিদা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এসব তথ্য থেকে জানা গেছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যঘাটতি এখন পাহাড়-সমান।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থলপথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে উন্নত ও সহজতর করার লক্ষ্যে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি ও বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন ২০০১ (২০০১ সালের ২০নং আইন) বলে ‘বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্তৃপক্ষ ২০০২ সালে স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এ কর্তৃপক্ষের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি শুল্ক স্টেশনকে সরকার কর্তৃক স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৭টি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর হিসেবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১২টি স্থলবন্দর যথা- যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আখাউড়া, সাতক্ষীরার ভোমরা, শেরপুরের নাকুগাঁও, সিলেটের তামাবিল, কুড়িগ্রামের সোনাহাট, ময়মনসিংহের গোবরাকুড়া কড়ইতলী, ফেনীর বিলোনিয়া, সিলেটের শেওলা, জামালপুরের ধানুয়া কামালপুর ও খাগড়াছড়ির রামগড় বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে।
দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর ব্যতীত অন্য ৫টি স্থলবন্দর যথা- পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, চাপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, দিনাজপুরের হিলি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিওটি (বিল্ড, অপারেইট, ট্রান্সফার) ভিত্তিতে পোর্ট অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭টি হবিগঞ্জের বাল্লা, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, দিনাজপুরের বিরল, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ, রাঙামাটির টেগামুখ ও নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান ও চালুর অপেক্ষাধীন রয়েছে।
স্থলবন্দরগুলোর আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি ও সরকারি রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। একই সঙ্গে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও সীমান্ত চোরাচালান হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক (ট্রাফিক) ওবাইদুল মিয়া স্বাক্ষরিত পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত অর্থবছরে ৯৫ হাজার ৮৯৯টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানিপণ্যের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ১১ হাজার ২৬৭ টন এবং ৪৭ হাজার ৪৩৭টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল চার লাখ ২১ হাজার ৭১৩ টন। একই সময়ে ভোমরা বন্দর দিয়ে ৬০ হাজার ১৫৬টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৪৪ হাজার ৯ টন এবং ২২ হাজার ৯৮৭টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮৬ হাজার ১৪৬ টন। গোবরাকুড়া-কড়ইতলী বন্দর দিয়ে ৩ হাজার ৩৩৬টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৩৮ হাজার ৫৫৬ টন এবং রপ্তানির পরিমাণ ছিল শূন্যের কোঠায়। সোনাহাট বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৫৫৯টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫১ টন এবং এক হাজার ২৪৫টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৭ টন। সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে ৭৬ হাজার ৬৯৩টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৩৬ লাখ তিন হাজার ১৪৪ টন এবং দুই হাজার ১৪১টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৮২০ টন। বুড়িমারী বন্দর দিয়ে ৭১ হাজার ৬৯৩টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ২৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৫ টন এবং ১৮ হাজার ৪৮৬টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬৯ হাজার ৪৫১ টন। হিলি বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৪৯৬টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৬ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮৮ টন এবং ৬৮৬টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৫৪ টন। বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে গত অর্থবছরে ৫০ হাজার ৩১২টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ১৫ লাখ ২৪ হাজার ২৩৯ টন এবং ৫ হাজার ৯০৯টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ৯৪৬ টন। ধানুয়া-কামালপুর বন্দর দিয়ে ৩ হাজার ৩৩১টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৩৯ হাজার ৫৭১ টন এবং ১৯টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫২ টন। বিবিরবাজার বন্দর দিয়ে ৫৩০টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ২ হাজার ৩২৬ টন এবং ৫ হাজার ৩৯টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ৩২১ টন। আখাউড়া বন্দর দিয়ে ২৬টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ১৪০ টন এবং ৫ হাজার ২২৮টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৯২৯ টন। বিলোনিয়া বন্দর দিয়ে দুটি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৩৮ টন এবং ৩ হাজার ৯৩১টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৬ হাজার ৪৮২ টন। নাকুগাঁও বন্দর দিয়ে ৯ হাজার ৭৭৯টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ তিন লাখ ২৩ হাজার ৮৯৬ টন এবং রপ্তানির পরিমাণ ছিল শূন্যের ঘরে। টেকনাফ বন্দর দিয়ে এক হাজার ৩৮০টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ১৫ হাজার ৮৩৭ টন এবং ৫৮৪টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮২২ টন। শেওলা বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৫৫৩টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ চার লাখ ৯০ হাজার ৯০২ টন এবং চার হাজার ৬২টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৭৭৮ টন ও তামাবিল বন্দর দিয়ে ৬ হাজার ৮০৯টি ভারতীয় ট্রাকে আমদানির পরিমাণ ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫ টন এবং ২০৭টি বাংলাদেশি ট্রাকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৮৫ টন।
চলমান ১৬টি বন্দরের মধ্যে সব চাইতে বেশি পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয়েছে ভোমরা বন্দর দিয়ে এবং কম আমদানি হয়েছে বিলোনিয়া বন্দর দিয়ে। সব চেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে বেনাপোল বন্দর দিয়ে এবং সব চাইতে কম রপ্তানি হয়েছে ধানুয়া কামালপুর বন্দর দিয়ে। এ ছাড়া রপ্তানি শূন্যের ঘরে ছিল গোবরাকুড়া-কড়ইতলী ও নাকুগাঁও বন্দর দিয়ে।
ভারত-বাংলাদেশ ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কমিটির চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান বলেন, স্থলপথে ব্যবসায়ীরা আরো পণ্য আমদানি-রপ্তানির ইচ্ছা থাকলেও বন্দরগুলোর অনুন্নত অবকাঠামোর কারণে বাণিজ্যপ্রসার ঘটছে না। ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান (বিবিআইএন) স্থলপথে চার দেশের বাণিজ্য চুক্তি আলোর মুখ দেখছে না। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ আর চাহিদা আছে এমন বন্দরগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়নের প্রতি সরকারকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ সিঅ্যান্ডএফ ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি মো,মফিজুর রহমান স্বজন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোর নাজুক অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। চাহিদা মতো অবকাঠামো উন্নয়ন না হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় খেসারত গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন করা হলে আমদানি খরচ যেমন কমবে তেমনি সরকারের রাজস্ব আয় দ্বিগুণ বাড়বে।
বেনাপোলে বন্দর ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, দেশের চলমান ১৬টি বন্দরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক চাহিদা বেনাপোল বন্দর দিয়ে। প্রতি বছর এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি-বাণিজ্য হতো। তবে ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তনে নানা সমস্যার কারণে এ রুটে বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। এতে দুই দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বন্দরবিষয়ক সম্পাদক মেহের উল্লাহ বলেন, বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশ কয়েকটি বন্দরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বসে বসে কর্মচারীরা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। কিন্তু কোনো ধরনের আমদানি-রপ্তানি হয় না। এসব বন্দর অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক চাহিদার গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়নি।
বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) শামীম হোসেন জানান, বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কাছে বেনাপোল বন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানির পরিমাণ কমেছে। বাণিজ্য সহজিকরণের বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে বেনাপোল বন্দরে নতুন জায়গা অধিগ্রহণ ও আধুনিক সুবিধা নিয়ে কয়েকটি পণ্যগার ও ইয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। রেলে আমদানি হওয়া কিছু পণ্য বন্দরে খালাসের ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি আরো জানান, রেলে রপ্তানি বাণিজ্য চালুর চেষ্টা চলছে। আমদানিপণ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্প-কলকারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, শিশুখাদ্য, মেশিনারিজ দ্রব্য, অক্সিজেন, শিশুখাদ্য, বিভিন্ন প্রকারে ফল, চাল, পেঁয়াজ, মাছসহ বিভিন্ন পণ্য। বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বসুন্ধারা টিস্যু, মেলামাইন, কেমিক্যাল, মাছ, পাট, সাবান, তৈরি পোশাক ও ওয়ালটন পণ্যসামগ্রী।


