প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলসের এমডি মোহাম্মদ আমিরুল হক। শিপিং দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও বিশাল এক শিল্পপরিবার গড়ে তুলেছেন তিনি। এখন তার ৩০ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ৩০০০ কোটি টাকা। ব্যবসায়ী এই নেতা ১৫ বছর চিটাগং চেম্বারের ও চার বছর এফবিসিসিআইর পরিচালক ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি নিয়ে সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন :আপনার ব্যবসা শুরুর গল্প জানতে চাই?
আমিরুল হক: আমার বাবা নুরুল হক একজন আইনজীবী হলেও শিপিং এজেন্সি ব্যবসা ছিল তার। সে সময় এটি খুব রমরমা ব্যবসা ছিল। এর পর আমি হাল ধরি সীকম শিপিংয়ের। একপর্যায়ে বিসিআইসির সারও রফতানি শুরু করি। পর্যায়ক্রমে কক্সবাজারে হ্যাচারি, ব্যাগের ফ্যাক্টরি ও রাবার বাগান গড়ে তুলি। আসলে বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা করেই উত্থান হয়েছে আমাদের।
প্রশ্ন:বন্দর দিয়ে উত্থান হলেও এখন কেন এ ব্যবসা গুটিয়ে আনছেন?
আমিরুল হক: মেসার্স ক্ল্যাসিক করপোরেশন গঠন করে ১৯৯৫ সালে প্রথম বন্দরে বেসরকারি খাতে সরঞ্জাম আনি আমরা। প্রথমে আনা হয় স্ট্রাডল ক্যারিয়ার। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় ১৬ মাস এসব সরঞ্জাম প্যাকেটবন্দি ছিল। অথচ জনতা ব্যাংক থেকে ১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এগুলো আনা হয়। হতাশ হলেও ভেঙে পড়িনি। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেন। এরপর আরও চারটা স্ট্রাডল ক্যারিয়ার আনি। স্বার্থান্বেষী মহল বাধা দিচ্ছিল তখনও। দেখলাম, বন্দরের বার্থ ও টার্মিনাল অপারেটর শুধু শ্রমিক সাপ্লাই দেয়, সরঞ্জাম কেনে না। তাই বন্দর থেকে দূরে সরে মনোযোগ দিলাম শিল্পায়নে। মনে হচ্ছিল, শিল্পকারখানা করলেই মানুষের কর্মসংস্থান হবে। উপকার হবে দেশেরও।
প্রশ্ন: সিমেন্ট ছাড়া আপনাদের বিনিয়োগ নিয়ে জানতে চাই?
আমিরুল হক: ২০০১ সালে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রিমিয়ার সিমেন্ট স্থাপন করি। এখন এর টার্নওভার এক হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে অধিগ্রহণ করি ন্যাশনাল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। মংলায় ২০১০ সালে একটা ট্যাঙ্ক টার্মিনাল করেছি। এর সঙ্গে অয়েল ট্যাঙ্কার দিয়ে জাহাজ ব্যবসা শুরু করি ১৯৯১ সালে। এখন লাইটারসহ জাহাজ আছে ৪০টি। মেঘনা নদীর তীরে পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারি গড়ে তুলি ২০১২ সালে। একই বছর মংলায় এডিবয়েল অয়েল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করি। এখন ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ করছি। ২০১৭ সালে উৎপাদনে আসবে এটি। লক্ষ্য আছে, বিনিয়োগ বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে এটি ৩০০ কোটিতে নিয়ে যাব। একটা শিপ বিল্ডিং ইয়ার্ড করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি ধলেশ্বরী নদীর তীরে। এখানে বিনিয়োগ বাড়াতে চাই ১৫০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন: প্রিমিয়ার সিমেন্টের পরিধি বাড়াচ্ছেন কীভাবে?
আমিরুল হক: প্রিমিয়ার সিমেন্টের বর্তমান নয় হাজার টন দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ২৪ হাজার টন করতে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ঢাকায় কারখানার আকার বড় করা হচ্ছে। এখন নির্মাণকাজ করছে বিশ্বসেরা ‘এফএল স্মিথ’ কোম্পানি। ২০১৮ সালে বর্ধিত এ প্রকল্প উৎপাদনে যাবে। আমাদের কারখানাকে পরিবেশবান্ধব করতে ভিআরএম পদ্ধতি ব্যবহার করে ফ্যাক্টরি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এতে ৪০ শতাংশ জ্বালানি বাঁচবে।
প্রশ্ন: দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
আমিরুল হক :বিনিয়োগের পরিবেশ নেই- এ কথা বিশ্বাস করি না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা থাকার পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশ কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোচ্ছে না। আগামী দুই দশকে বাংলাদেশ পাল্টে যাবে। মানবসম্পদের পাশাপাশি এ দেশের উদ্যোক্তারাও বিশ্বমানের। আমি মনে করি, এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ পরিবেশ আছে বাংলাদেশে।
প্রশ্ন: ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের জন্য আর কী করতে পারে সরকার?
আমিরুল হক: শুধু সরকারের সমালোচনা করা ঠিক নয়। সরকার কাউকে জমি কিনে দেবে না। তবে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। ব্যাংক সুদের স্প্রেড মুনাফা কমানো যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য হাপিত্যেশ না করে দরকার দেশি শিল্পের দৃঢ় অবস্থান। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা নির্ধারণ করে দিতে পারে। ‘ফরেন কারেন্সি লোন’ আনার প্রক্রিয়াও সহজ করা যেতে পারে। ২০০০ সালেও সিমেন্ট আমদানি হতো; অথচ এখন রফতানি করছি আমরা। কনডেনসেড মিল্ক, ওষুধ, ঢেউটিন, টাইলস, সিমেন্ট ও চালের মতো পণ্যও আমদানির বদলে রফতানি করছি। আড়াই কোটি টন সিমেন্ট উৎপাদন হয়েছে এ বছর। গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থারও অনেক উন্নতি হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণসহ সার্বিক উন্নয়নে সরকারের মনোযোগ ছিল বলেই পাল্টে যাচ্ছে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ পেলে ২০২৫ সালের মধ্যে এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ | সূত্র: সমকাল।