নিজস্ব প্রতিবেদক : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তৃতীয় জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার নামাজ পড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব সৈয়দ এমদাদ উদ্দিন।
এ সময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ অন্যান্যরাও জানাজায় অংশ নেন। জানাজা শেষে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সহকর্মীদের পক্ষ থেকে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর জানাজা শেষে সাভারে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে বারিশ চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এ কথা জানান।
জানাজা শুরুর আগে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে বারিশ চৌধুরী বলেন, আমার বাবার সারা জীবনের ইচ্ছা ছিল যে, তার দেহ মেডিকেল সায়েন্সের জন্য দান করা হোক। আমরা তার সন্তান হিসেবে এ ইচ্ছাটি পূর্ণ করতে চেষ্টা করেছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ যেখানে তিনি পড়েছিলেন, তা না হলে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল, যেটা তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে দেহ দান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠান থেকেই আমরা শুনেছি, এমন কেউ নেই যিনি আমার বাবার মরদেহে ছুরি লাগাতে পারবেন।
সম্মান থেকেই এমনটি (মরদেহে ছুরি লাগাতে না পারা) বলা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা খুব করে চেয়েছিলাম, কারণ তিনি সারা জীবন একটি উদাহরণ হতে চেয়েছিলেন। তার এ শেষ ইচ্ছাটাও আমরা পূর্ণ করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখন সম্মান থেকে, ভালোবাসা থেকে আমাদের বলা হচ্ছে যে, কেউ উনার মরদেহে হাত দিতে রাজি নন। এরপর তো আমাদের আর কিছু করার থাকে না। আমরা চাচ্ছি, সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেখানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল গড়েছেন, যেখানে এত বছর ধরে কাজ করেছেন, এ দেশের মানুষের জন্য, স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষ করে গরিব মানুষের জন্য কাজ করেছেন, সেখানে তাকে আমরা দাফন করবো।
বারিশ চৌধুরী বলেন, আমার বাবা কোনো অন্যায় বা কাউকে দিয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন। কারও কাছে কোনো ঋণ করে থাকলে, সেটা আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমার বাবা ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পরেও তার যুদ্ধ শেষ হয়নি। তার যুদ্ধ তার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত চলেছে। তার কাছে সবচেয়ে বড় ছিল দেশ ও দেশের মানুষ এবং মানুষের অধিকার। আর এজন্য তিনি সারাজীবন লড়াই করেছেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে ফ্রিজিং ভ্যানে মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়ার পর সবার আগে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী। পরে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের নেতারা, রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল, ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাত ১১টার দিকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ডা. জাফরুল্লাহ। ৮২ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরেই কিডনি সমস্যার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। বর্তমানে তার মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার কোয়েপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা হাছিনা বেগম চৌধুরী ছিলেন গৃহিণী। মা–বাবার দশ সন্তানের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর হাসপাতালের অনিয়ম–দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আলোচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৬৪ সালে এমবিবিএম পাস করে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি সাধারণ সার্জারি ও ভাসকুলার সার্জারিতে প্রশিক্ষণ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করা, হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনের নানা পর্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় সরকার। ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। ১৯৯২ সালে সুইডেন থেকে তাঁকে দেওয়া হয় রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে দেয় ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি থেকে ২০১০ সালে দেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন ভাসকুলার সার্জন হলেও মূলত জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্পধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে। নাগরিক অধিকার আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।