কাজী মসিহুর রহমান ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে দায়িত্ব পালন করছেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে। এর আগে এক্সিম ব্যাংকের এমডি ও প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি পদেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও দেশের ব্যাংকিং খাতের গতিপথ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেণ এক একটি দৈনিক পত্রিকার সাথে।
প্রশ্ন: প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পূর্ণ করে ২০ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। দীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি কতটুকু?
কাজী মসিহুর রহমান: যেকোনো ব্যাংকের জন্য ২০তম বর্ষে পদার্পণ গৌরবের। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংক এখন যৌবনে পদার্পণ করেছে। পেরিয়ে আসা সময়টি আমাদের ব্যাংকের জন্য গর্বের। আমি মনে করি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৪০ বছরের পথ ২০ বছরেই অতিক্রম করতে পেরেছে। শক্তিশালী সমৃদ্ধ ব্যাংক হিসেবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অচিরেই দেশের ব্যাংকিং খাতের এক-দুটি ব্যাংকের নাম নিলে মার্কেন্টাইলের নাম চলে আসবে। এ পর্যায়ে আসার মতো শক্ত একটি পাটাতন তৈরি হয়েছে। আমরা মুডি’সের রেটিংয়ে ‘বি-১’ অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অডিট প্রতিবেদন নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। বৃহৎ শিল্প ক্যাটাগরিতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক ‘ন্যাশনাল প্রডাক্টিভিটি অ্যান্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৬’ অর্জন করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট কর্তৃক আমরা বৃহৎ করদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়ে আসছি। সেন্টার ফর এনআরবি কর্তৃক আমরা ‘টপ টেন রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড-২০১৭’ পেয়েছি। এছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংক দেশী-বিদেশী বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাফল্যের স্বীকৃতি পেয়ে আসছে।
প্রশ্ন: পথচলার এ সময়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিসর কতটুকু সম্প্রসারণ হয়েছে?
কাজী মসিহুর রহমান: সারা দেশে ১২৯টি শাখা ও ১৬২টি এটিএম বুথের মাধ্যমে মার্কেন্টাইল ব্যাংক গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনার জন্য আমরা বিশ্বের ৬২২টি ব্যাংকের সঙ্গে করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকিং রিলেশনশিপ তৈরি করেছি। দেশী-বিদেশী ৩৩টি এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কষ্টার্জিত অর্থ দ্রুত ও নিরাপদে আমরা স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। এছাড়া আই-ব্যাংকিংসহ আধুনিক সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা প্রদানে মার্কেন্টাইল ব্যাংক একযোগে কাজ করছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে আমাদের ব্যাংকের ব্যালান্সশিট আকার ২৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাছে জমা আছে গ্রাহকদের ২১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকার আমানত। এ সময় পর্যন্ত আমরা ২০ হাজার ৩০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছি। ২ হাজার ১৭২ জন ব্যাংকার নিয়ে আমরা গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: ব্যাংকের পরিসর বৃদ্ধিতে নতুন কী উদ্যোগ নিচ্ছেন?
কাজী মসিহুর রহমান: এতদিন আমরা ব্যাংকের একটি প্রডাক্ট হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলাম। এখন আমরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য পৃথক সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরই মধ্যে পরিচালনা পর্ষদ এটির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য আমরা দক্ষ জনবল নিয়োগ দেব। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দুটি এক্সচেঞ্জ হাউজ আছে। নতুন করে আমরা একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি খোলার উদ্যোগ নিয়েছি। এটির মাধ্যমে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের কার্যক্রমও পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক এরই মধ্যে অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছে। এসব উদ্যোক্তাকে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ বছরের মধ্যেই নতুন উদ্যোগগুলো কার্যকর করা হবে। চলতি বছর আমরা নতুন ১০টি শাখা খোলার কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছি। একই সঙ্গে ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যাও বাড়ানো হবে। গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য আমরা ২৪ ঘণ্টার জন্য একটি সমৃদ্ধ কল সেন্টার চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিসর আরো বিস্তৃত হবে। গণমানুষের ব্যাংক হওয়ার পথে এগুলো হবে আরেক ধাপ অগ্রগতি।
গ্রাহকদের সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করা আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এজন্য আইটি খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এতদিন আমরা ভার্সন-১০-এ ছিলাম। এখন আমরা ভার্সন-১৭তে যাওয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আগামী বছরের মধ্যেই মার্কেন্টাইল ব্যাংক সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যাংকে উন্নীত হবে। আগে থেকেই আমরা সেন্ট্রালাইজড মডেলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
প্রশ্ন: এ মুহূর্তে মার্কেন্টাইল ব্যাংক কেমন চলছে?
কাজী মসিহুর রহমান: আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমাদের গ্রাহক সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রডাক্ট বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মার্কেন্টাইল ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। ব্যাংকের সবক’টি সূচকে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে ব্যাংকের মুনাফায়ও। বিদায়ী বছর ২২৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখা সত্ত্বেও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩০১ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। কয়েক বছর ধরে আমাদের ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি ছিল ধারাবাহিক। বণিক বার্তার সর্বশেষ র্যাংকিংয়ে দেশের শীর্ষ ব্যাংকের তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করতে পারা আমাদের জন্য গৌরবের। এখন পর্যন্ত মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আইটি খাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। বড় ধরনের কোনো ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার ঘটনাও কেউ বলতে পারেনি। গ্রাহক ও জনগণের মধ্যে আমাদের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক চর্চা নেই। আমাদের সম্পর্কে মানুষের আস্থার জায়গাটি আরা সমৃদ্ধ হচ্ছে।
প্রশ্ন: মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিনিয়োগ পরিধি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ আছে। এ অভিযোগের সত্যতা কতটুকু?
কাজী মসিহুর রহমান: আমরা ক্লাস ব্যাংকিংয়ে বিশ্বাসী নই। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের স্লোগান হলো ‘বাংলার ব্যাংক’। এটি শুধু স্লোগানের মধ্যেই সীমিত নেই। সাধারণ জনগণ আমাদের কাছে সহজেই ভিড়তে পারে। গ্রাহকবান্ধব হওয়ায় জনগণের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। বর্তমানে আমরা কোনো ক্লাস ব্যাংকিং করছি না। কৃষি, এসএমই, রিটেইল, পোশাক খাত কিংবা বৃহৎ শিল্প সব খাতেই আমাদের ব্যাংকের বিনিয়োগ আছে।
প্রশ্ন: ব্যাংক পরিচালনায় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের স্বাধীনতা কতটুকু?
কাজী মসিহুর রহমান: ১২ বছর ধরে আমি ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপক পদে কাজ করছি। দেশের অনেক ব্যাংকের পর্ষদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বলতে পারি, আমি ভাগ্যবান। ব্যাংক পরিচালনায় আমিসহ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত অন্যরা শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছেন। আমাদের পরিচালনা পর্ষদ নীতিমালা দেয়ার জায়গায় কাজ করছে। ব্যাংক পরিচালনায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের নিয়োগ, পদোন্নতি, দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণে কর্মকর্তাদের প্রেরণ, ঋণ বিতরণসহ সব ক্ষেত্রেই আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। পর্ষদ তার দায়িত্ব পালন করেছে। আর আমরা ব্যাংক পরিচালনার কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: বেসরকারি ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?
কাজী মসিহুর রহমান: কয়েক মাস ধরে সব বেসরকারি ব্যাংকেই আমানত নিয়ে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এটিকে আমি তারল্য সংকট বলতে চাই না। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার কারণেই সমস্যা হয়েছে। তবে গত এক-দুই মাসে এটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে এসেছে। তারল্যের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংকের তেমন কোনো সমস্যা নেই। স্বাচ্ছন্দ্যেই আমরা ব্যাংক পরিচালনা করছি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এডি রেশিও সাড়ে ৮৩ শতাংশে নেমে আসবে। ব্যাংকারদের উচিত হবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ বিতরণ করা। অন্যথায় একটি ব্যাংকের খারাপ পরিস্থিতি পুরো খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। সৌজন্যে: বণিক বার্তা
আরও পড়ুনঃ ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি আরও মজবুত করতে চায় এফবিসিসিআই