ঢাকার অধিবাসীদের জন্য মানসম্পন্ন বাসস্থান সরবরাহের অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৮৮ সালে যাত্রা করে শেলেটক্। কালের পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের অন্যতম শীর্ষ রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। ৩০ পেরিয়ে আগামীকাল ৩১ বছরে পা দেবে শেলেটক্। তিন দশকের এ যাত্রায় নানা চ্যালেঞ্জ ও সফলতার গল্প তুলে ধরেছেন শেলেটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌফিক এম সেরাজ।
প্রশ্ন: শেলেটক্ ৩০ বছর পেরিয়ে ৩১-এ পদার্পণ করছে। তিন দশকের এ যাত্রা কেমন ছিল?
তৌফিক এম সেরাজ: শেলেটক্ যখন প্রথম রিয়েল এস্টেট কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন থেকেই অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে পণ্যের গুণমান বজায় রাখা এবং ক্রেতাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। ৩০ বছর পরও এ দুটি বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ২০১২ থেকে ২০১৬ যখন আবাসন খাতের অবস্থা খারাপ ছিল, তখন অনেকে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ কমিয়ে দেন বা বন্ধ করে দেন। কিন্তু প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হোক বা না হোক, আমরা বিভিন্ন প্রকল্প চালিয়ে গিয়েছি। সে সময় ব্যাংকঋণের পরিমাণ বেড়েছে, দু-চারটা প্রকল্পে সেভাবে মুনাফা হয়নি, এমনকি লোকসানও হয়েছে, তার পরও আমরা সময়মতো গ্রাহকদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছি। ফলে সেসব ক্রেতাই অন্যদের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছেন। সেই গ্রহণযোগ্যতা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও অর্জন করা সম্ভব হতো না। খারাপ সময়েও যে আমরা আমাদের প্রকল্প ধরে রেখেছি, তার সুফল গত এক বছরে পাচ্ছি। গত চার বছরের তুলনায় ব্যবসা এখন অনেক ভালো। এ ধারায় আমরা এগিয়ে থাকব।
রিয়েল এস্টেটের বাজারে সুনামটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের কাছে প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট কেনাটা জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এখানে বিনিয়োগ করে কেউ যদি প্রতারিত হয় বা তার আশা ভঙ্গ হয়, এর চেয়ে কষ্টের কিছু হতে পারে না। সে কারণে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট যারা কেনেন, তারা জানেন শেলেটক্ কথা দিলে কথা রাখে। জমির মালিকদেরও আমাদের ওপর আস্থা রয়েছে।
প্রশ্ন: এ খাতে নেতৃত্ব দেয়ার পথে কী কী বাধা ছিল?
তৌফিক এম সেরাজ: আমরা যে সময় এ খাতে ব্যবসা শুরু করি, তখন রিয়েল এস্টেট একেবারে নতুন একটি খাত। আজ থেকে ৩০ বছর আগে অ্যাপার্টমেন্টে থাকার কথা কেউ কল্পনাও করত না। সে কারণে অ্যাপার্টমেন্ট বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাটা সে সময় ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া ব্যাংক কীভাবে ঋণ দেবে, সরকার কীভাবে ভ্যাট নেবে, সে বিষয়েও কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন করার বিষয়টিতেও কীভাবে কী করা হবে, সে বিষয়ে অনেকের ধারণা ছিল না। আমরা যারা প্রথম দিকে এ ব্যবসা শুরু করেছি, তাদের এসব নিয়মনীতি তৈরি করার জন্য সরকারকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, তত নিয়মকানুন বাড়ছে। এতে করে একদিকে ফ্ল্যাটের মান উন্নত হচ্ছে, অন্যদিকে আবার নতুন করে বেশকিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা বাড়ছে। রেজিস্ট্রেশনের খরচ-সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হচ্ছে, প্রতি বছর বাজেটের আগে এসব নিয়ে বেশ একটা আলোচনা হলেও পরে আবার দেখা যায় সব আগের অবস্থায় আছে। এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করা জরুরি, যাতে ক্রেতা বা ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ তৈরি না হয়। আবাসন খাতে একসময় ব্যাংকের সুদের হার খুব বেশি ছিল। ধীরে ধীরে তা কমছিল, যার সুফল পাচ্ছিলেন গ্রাহকরা। কিন্তু এখন আবার সুদের হার বাড়তে শুরু করেছে, এসব বিষয়ে এখনই নজর দিতে হবে।
প্রশ্ন: রিয়েল এস্টেট ছাড়া নতুন কোন খাতে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করছেন?
তৌফিক এম সেরাজ: আমরা সিরামিক টাইলস খাতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছি, স্পান প্রিস্ট্রেসড কংক্রিট (এসপিসি) পোল খাতে ব্যবসা শুরু করেছি। এরই মধ্যে সিলেটের একটি কোম্পানিতে পোল তৈরির কাজ শুরু করেছি।
প্রশ্ন: আবাসন খাতে নতুন আর কোনো প্রকল্প নিচ্ছেন?
তৌফিক এম সেরাজ: মিরপুরে শেলেটক্ বিথীকা, উত্তর বাড্ডায় শেলেটক্ রেনু-কবির টাওয়ার ও মালিবাগে শেলেটক্ এনক্লেভ টাওয়ার নামে একটি প্রকল্প হচ্ছে। মালিবাগের প্রকল্পটিতে এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। কিন্তু এটি আমাদের ৩০ বছরের ব্যবসা জীবনে একটি অর্থবহ প্রকল্প।
শেলেটক্ এনক্লেভ ছিল আমাদের প্রথম প্রকল্প। ১৯৮৯ সালের প্রকল্প, ১৯৯১ সালে ফ্ল্যাট ডেলিভারি দিয়েছি। চারতলা ভবনে ৮০০ বর্গফুটের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট, ৬ লাখ টাকা দাম। সেই প্রকল্পের ছয় কাঠা জমি আর আশপাশের অনেক জমি নিয়ে এবার ৩৩ কাঠা জমির ওপর আমরা ২০ তলা ভবন বানাতে যাচ্ছি। মধ্যবিত্তের জন্য মালিবাগের প্রকল্পটিতে এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট ৮০-৮৫ লাখ টাকার মধ্যে দিতে পারব।
আরও পড়ুন: সাক্ষাৎকার ছাড়াই ভারতীয় ভিসা
প্রশ্ন: নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রতি কোনো আহ্বান?
তৌফিক এম সেরাজ: ভবনের নকশা অনুমোদনে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীদের বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অথচ চাইলেই এটি কমিয়ে আনা যায়। আবার ইমারত নির্মাণে যেসব নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো যদি সবাই মেনে চলত, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা কমিয়ে আনা যেত। ভবনের নকশা অনুমোদন করার জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু নকশা অনুমোদনে যেন দীর্ঘসূত্রতা না হয়। এতে আমাদের মতো প্রতিষ্ঠিত বড় প্রতিষ্ঠানের খুব বেশি সমস্যা না হলেও ছোট ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের বেশ সমস্যা হয়।
প্রশ্ন: আবাসন ব্যবসার ভবিষ্যৎ কী?
তৌফিক এম সেরাজ: রিয়েল এস্টেট খাত এমন একটি খাত, যার কোনো বিনাশ নেই। নগরায়ণ হবে, শহরের আওতা বাড়বে। একটি বড় শহর যতদিন থাকবে, পৃথিবীর যেকোনো দেশে, যেকোনো সমাজে রিয়েল এস্টেট কোনো না কোনো ফর্মে থাকবে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ, এ কারণে এ দেশে রিয়েল এস্টেট কোনো না কোনো ফর্মে থাকবে। ক্রেতা প্রতিনিয়ত সচেতন হচ্ছেন আর ডেভেলপারদের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রও বাড়ছে। ক্রেতার সচেতনতা আবাসন খাতের ব্যবসায়ীর মার্জিন অব প্রফিট বাড়িয়ে তুলছে। সাধারণত রিয়েল এস্টেট খাত পাঁচ-সাত বছর পর পর একটি খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়, পরে আবার পরিস্থিতি ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ২০১৭ সালের পর আবার নতুন করে ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে। ধীরগতিতে এটি বাড়তে থাকবে। কোনো অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অথবা সামাজিক উন্নয়ন যদি এ দেশে হয়, তখন হঠাৎ করে চাহিদা একটু বেশি বেড়ে যাবে। তবে সাধারণত রিয়েল এস্টেট খাতে চাহিদা থাকবেই। নতুন নতুন মানুষ কর্মসংস্থানে যুক্ত হবে। তাদের জন্য নতুন নতুন বাড়ির চাহিদা বাড়বে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে স্টুডিও সাইজ অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বাড়বে।
প্রশ্ন: ঢাকার বাইরে আবাসন খাতের ব্যবসা নিয়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে?
তৌফিক এম সেরাজ: আমরা বেশ খানিকটা রক্ষণশীল ব্যবসায়ী, অত বড় হতে চাই না। ৩০ বছরে কয়েকবার চট্টগ্রামে যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি। গুণগত মানের সঙ্গে যাতে আপস করতে না হয়, সে কারণে অ্যাপার্টমেন্ট বানাতে গত ৩০ বছরে সবকিছু নিজেরা দেখভাল করেছি, পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এভাবে না-ও চালাতে পারে। ব্যবসা আরো বড় করতে তারা হয়তো সে বিষয়ে ভাববে।
আরও পড়ুন: কর্মী ব্যবস্থাপনায় সফটওয়্যারভিত্তিক সেবা দিচ্ছি: ইরাম রহমান
সূত্র- বণিক র্বাতা