২৭ রজব রাতকে শবে মেরাজ বলা হয়। এই রাতে মহানবী (স.) বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন এবং আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইসলামে মেরাজের রাত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই রাতে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মোজেজা সংঘটিত হয়।
মেরাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা, সোপান ইত্যাদি। রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে জাগ্রত অবস্থায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা, এরপর বোরাকে করে ঊর্ধ্বাকাশ পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করার নামই মেরাজ। কোরআনে কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি বান্দাকে তাঁর নিদর্শনগুলো দেখানোর জন্য রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার পরিবেশ পবিত্র, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১)
শবে মেরাজ কী ও কেন
লাইলাতুন বা শব অর্থ হলো- রাত আর মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। শবে মেরাজ বা লাইলাতুল মেরাজের অর্থ দাঁড়ায়- ঊর্ধ্বগমনের রাত। ‘রজবের’ ২৭ তারিখ নবুয়তের দশম বর্ষে নবী কারিম (স.)-এর ৫০ বছর বয়সে পবিত্র মেরাজ সংঘটিত হয়। (সূত্র: সিরাতে মোস্তফা: আশেকে এলাহি মিরাঠি, ও তারিখুল ইসলাম: মাওলানা হিফজুর রহমান সিহারভি)
পবিত্র মেরাজের যাত্রা শুরু হয় মসজিদে হারাম থেকে। হজরত জিব্রাইল (আ.) বোরাকে করে নবীজিকে বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ে যান। ওখানে তিনি দুই রাকাত নামাজ পড়েন। ওই নামাজে নবীজি (স.) সব নবীর ইমামতি করেন। এরপর ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে প্রত্যেক আসমানে পূর্ববর্তী সম্মানিত নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এরপর সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে আরশে আজিমে মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পবিত্র মেরাজের রাতে বিশ্বনবী (স.) স্বচক্ষে বেহেশত-দোজখ দেখেছেন। অনেক পাপের শাস্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। সুবিশাল নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ, আরশ-কুরসি প্রভৃতি সামনাসামনি সশরীরে দেখা, সর্বোপরি মহান রবের সঙ্গে পবিত্র দিদার লাভ করাসহ অবলোকন করেছেন সৃষ্টিজগতের অপার রহস্য। নামাজের বিধান রচিত হয় এ রাতেই।
মেরাজের ঘটনা থেকে মুমিন খুঁজে পায় সঠিক পথের দিশা, লাভ করে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দ্বীনের অবিচলতা। প্রিয়নবী (স.) যে আল্লাহ তাআলার কাছে কত দামি ও মর্যাদার অধিকারী, তা এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। তাঁকে এমন মর্যাদা দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো নবীকে দান করা হয়নি। এ ঘটনার ফলে মুমিনের ঈমান মজবুত হয় এবং হৃদয়ে বিশ্বনবী (স.)-এর ভালোবাসা সুগভীর হয়।
মেরাজের ঘটনা কোন সুরায় আছে
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মেরাজ কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে উম্মত-এর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। মেরাজ সত্য-এই বিশ্বাস রাখা ফরজ। মেরাজের রাতে নবীজির বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত সফরের কথা সুরা বনী ইসরাইলের শুরুতে এবং ঊর্ধ্ব জগতের সফরের কথা সুরা নাজমের ১৩ থেকে ১৮ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। মেরাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে গমনের কথা হাদিস দ্বারা আর ইসরা তথা নৈশভ্রমণের কথা কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। ইসরাকে অস্বীকারকারী কাফের হবে, কিন্তু মেরাজকে অস্বীকারকারী কাফের হবে না, তবে মহাপাপী হবে।
শবে মেরাজের বিস্তারিত ঘটনা
হাদিসের ভাষ্যমতে, মেরাজের সূচনা হয় মসজিদে হারাম থেকে। রাসুলুল্লাহ (স.) রজব মাসের ২৭-এর রজনীতে আল্লাহ তাআলার ঘরের হিজরের মাঝে শায়িত ছিলেন, এমন সময় ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এসে জাগ্রত করে তাঁর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে দূষিত রক্ত বের করে আবার জোড়া লাগিয়ে দেন। অতঃপর বোরাকে করে সশরীরে বায়তুল মাকদাসে নিয়ে যান। বোরাক হলো এমন একটি প্রাণী, যা গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি আকৃতির একটি জন্তু। তার দুই উরুতে রয়েছে দুটি পাখা। তা দিয়ে সে পেছনের পায়ে ঝাপটা দেয়, আর সামনের দৃষ্টির শেষ সীমায় পা ফেলে। প্রিয়নবী (স.) বায়তুল মাকদাসের দরজায় খুঁটির সঙ্গে বোরাকটি বেঁধে যাত্রাবিরতি করেন এবং সব নবীর ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করেন। (আর রাহিকুল মাখতুম)
বায়তুল মাকদাসে দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামাজ আদায় করার পর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নিচ থেকে ওপরে যাওয়ার জন্য ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে সশরীরে প্রথম আকাশে, অতঃপর অবশিষ্ট আকাশগুলোয় গমন করেন। এ সিঁড়িটি কী এবং কেমন ছিল, তার প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। প্রতিটি আকাশে সেখানকার ফেরেশতারা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান এবং প্রত্যেক আকাশে অবস্থানরত পয়গম্বরদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।
প্রথম আকাশে হজরত আদম (আ.)-কে, দ্বিতীয় আকাশে হজরত ইয়াহিয়া ও ঈসা (আ.)-কে, তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে, চতুর্থ আকাশে হজরত ইদরিস (আ.)-কে, পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন (আ.)-কে, ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা (আ.)-কে এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে দেখতে পান। এসব স্থান অতিক্রম করে তিনি এক ময়দানে পৌঁছেন। যেখানে ভাগ্যলিপি লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তারপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহা গমন করেন, যেখানে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি ইতস্তত ছোটাছুটি করছে। ফেরেশতারা স্থানটি ঘিরে রাখছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) সেখানে হজরত জিবরাইল (আ.)-কে তাঁর স্বরূপে দেখেন। তাঁর ছয় শ পাখা। সেখানে তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের ‘রফরফ’ দেখতে পান। রফরফ হলো সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট পালকি। রফরফের মাধ্যমে তিনি স্বীয় রবের কাছে গমন করেন। এ সফরে তাঁকে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়। তাঁকে দুধ ও মদ দেওয়া হয়েছিল। তিনি দুধ গ্রহণ করেন। এটা দেখে হজরত জিবরাইল (আ.) বলেন, আপনি স্বভাবগত বস্তু গ্রহণ করেছেন। আপনি মদ গ্রহণ করলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। মহানবী (স.)-কে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখানো হয়। জাহান্নামিদের শাস্তিও তিনি অবলোকন করেন। জাহান্নামের দারোগা মালেককে দেখেছেন। তাঁর চেহারায় হাসির কোনো ছাপ নেই।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (স.) আল্লাহ তাআলার এতটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন যে, দুজনের মধ্যখানে মাত্র এক ধনুক পরিমাণ ব্যবধান ছিল। এখানে রাসুলল্লাহ (স.)-এর উম্মতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতে মোহাম্মাদির ওপর ফরজ করেন, যা ইসলামের পাঁচটি রোকনের অন্যতম রোকন বা ভিত্তি। সহিহ বুখারির ৩৮৮৭ নং হাদিসে মেরাজের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে।
শবে মেরাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
মেরাজের ঘটনা পুরোটাই ঈমানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই রাতে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বিশেষ নৈকট্য দান করেন। মুসলমানদের জন্য নামাজ উপহার দেন। তাই নিঃসন্দেহে ওই রাত ছিল গুরুত্ববহ ও ফজিলতপূর্ণ। এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে কোনো মুসলমানের সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে, এ ঘটনার পর নবী (স.) অনেক বছর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শবে মেরাজকেন্দ্রিক কোনো আমলের ব্যাপারে বিশেষ হুকুম তিনি দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ রাতে রাসুলুল্লাহ (স.) নিজেও বিশেষ আমল করেননি, সাহাবিদেরও করতে বলেননি। রাসুল (স.) পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ১০০ বছর সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। শতাব্দীজুড়ে এমন একটি ঘটনাও পাওয়া যায়নি, যেখানে সাহাবায়ে কেরাম ২৭ রজবকে বিশেষভাবে উদযাপন করেছেন। সুতরাং যে কাজ রাসুল (স.) করেননি, সে কাজ সাহাবায়ে কেরামও পরিহার করেছেন। তাই ২৭ রজবে প্রচলিত ইবাদত-বন্দেগিগুলোকে দ্বীনের অংশ মনে করা, সুন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হাদিস ও সুন্নতসম্মত নয়।
বরং অনর্থক কাজ থেকে নিজেদের বিরত রেখে মেরাজের আসল তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে। বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করা। এ ছাড়াও শিরক না করা, পিতা-মাতার অবাধ্য আচরণ না করা, এতিমের মাল আত্মসাৎ করা থেকে বিরত থাকা, সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, খাদ্যাভাবে সন্তানকে হত্যা না করা, অহংকার ও অনুমাননির্ভর কাজ থেকে বিরত থাকা, জেনা-ব্যভিচারের ধারেকাছেও না যাওয়া, প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা আমরা মেরাজের ঘটনা থেকে পাই।
তবে অন্যান্য দিনের মতো এ রাতেও নফল ইবাদত করতে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া রজব মাস আমলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাস থেকে মহানবী (স.) রমজানের প্রস্তুতি শুরু করতেন। উম্মে সালমা (রা.) বলেন, নবী করিম (স.) রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে। আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, তা আমরা নবীজি (স.)-এর আমলের আধিক্য দেখে বুঝতে পারতাম।’ নফল নামাজ-রোজা যেকোনো রাতে করতে নিষেধ নেই, বরং উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই এ রাতের নির্দিষ্ট কোনো আমলের কথা না বলা হলেও কেউ আল্লাহপ্রেমে রাতের নামাজ-তেলাওয়াতে মশগুল হলে অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হবেন ইনশাল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক বিষয় সঠিকভাবে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।