চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের অন্যতম শিল্প পরিবার মোস্তফা হাকিম গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর আলম। এছাড়া চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র হিসেবেও পরিচিত তিনি। ২০১০ সালের নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হলেও পরবর্তীতে কারচুপির অভিযোগ তুলে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। বর্তমানে পারিবারিক ব্যবসা ও সমাজসেবায়ই নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। ব্যবসা প্রসারের ধারাবাহিকতায় মোস্তফা হাকিম গ্রুপের সহযোগী নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করবে গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড। সর্বোচ্চ মানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশের ইস্পাত খাতের বাজারে নেতৃত্ব দিতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। গোল্ডেন ইস্পাত নিয়ে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনীতিতে নিজের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে ৬৫ বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিবিদ মনজুর আলম কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: উদ্যোক্তা থেকে রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পর আবার নিজেকে প্রত্যাহার করেছেন?
মনজুর আলম: হ্যাঁ। গত তিন বছর মূলত পারিবারিক ব্যবসা ও সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। এর আগেও যখন রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, সমাজসেবাই আমার মূল লক্ষ্য ছিল। কারণ এটা এমন এক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বহু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মেয়র পদে দায়িত্ব পালন শেষে গত তিন বছরে নিজের পারিবারিক ব্যবসা প্রসারের পাশাপাশি সীতাকুণ্ডে একটি কলেজ, খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় একটি স্কুল ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে মসজিদ, মাদ্রাসা, জাতীয় কবরস্থানসহ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনেই বেশি মনোযোগ দিয়েছি। আমাদের মোস্তফা হাকিম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এসব সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ফাউন্ডেশন এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে।
প্রশ্ন: ব্যবসা সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় বাজারে গোল্ডেন ইস্পাত নিয়ে আসছেন। ইস্পাত খাতের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভালো করার ব্যাপারে কতটা আত্মবিশ্বাসী?
মনজুর আলম: দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা এ প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন আয়রন ও ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন স্টিল নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এখন ৪০ গ্রেডের রড উৎপাদন করে যাচ্ছি। এখন ৫০০-৫৫০ টিএমটি বার উৎপাদনে গোল্ডেন ইস্পাতের পথচলা শুরু হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে সীতকুণ্ডের বড় কুমিরা এলাকায় বার্ষিক দুই লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন অটো রি-রোলিং মিলটি সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিক উৎপাদনে যাচ্ছে। দেশব্যাপী বিশ্বমানের রড সরবরাহের প্রতিশ্রুতি নিয়েই আমাদের এ যাত্রা। গ্রাহকের প্রতি দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেই আগামীর নেতৃত্বে আসবে গোল্ডেন ইস্পাত। সর্বোচ্চ প্রযুক্তি নিশ্চিত করে মেশিনারি সেটআপ আনা হয়েছে জার্মানি থেকে। শুরুতে আমাদের লক্ষ্য বার্ষিক দুই লাখ টন গোল্ডেন ইস্পাত ব্র্যান্ডের টিএমটি এক্সট্রিম রড উৎপাদন করা। ভবিষ্যতে এ লক্ষ্যমাত্রা আরো বাড়ানো হবে। কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে ১২ একর জায়গার ওপর, যা পর্যায়ক্রমে ২০ একর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এ খাতের কাঁচামাল এখনো আমদানিনির্ভর। তবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় উত্স থেকে বিলেট উৎপাদন করে এ নির্ভরতা কমিয়ে আনা হবে।
প্রশ্ন: ইস্পাত খাতের বাজারে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা। এ সময় নতুন আরো একটি প্রতিষ্ঠানের পথচলা…
মনজুর আলম: ইস্পাতের বাজার প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামীতে উন্নয়ন আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে। দেশ গড়ার এ পথচলায় আমাদের অংশগ্রহণ ভালোভাবেই নিশ্চিত করতে চাই। আমাদের গ্রুপের ১৪টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান সরাসরি আবকাঠামো উন্নয়নসংশ্লিষ্ট। একটি বড় উদ্যোগের পেছনে ব্যবসায়িক দক্ষতা, পণ্য ও সেবার মান নিশ্চিত করাটা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয় নিশ্চিত করেই সারা দেশে গোল্ডেন ইস্পাত বাজারজাত করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছি আমরা। আস্থার প্রশ্নে মানুষের কাছে আমাদের গ্রুপ অব কোম্পানিজ প্রতিষ্ঠিত একটি নাম। এটাও আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন।
প্রশ্ন: ২০১৯ সালের নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেই মনজুর আলম নামটি বেশ আলোচিত হচ্ছে। আপনার ভাবনা কী?
মনজুর আলম: এটা সত্যি যে, রাজনীতিতে সরাসরি থাকলে গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা যায়। নির্বাচন আসতে এখনো দেড় বছরের মতো সময় বাকি। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনো কথা বলতে চাই না।
প্রশ্ন: আপনি সাড়ে তিন বছর ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও পাঁচ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এ সময়ে আপনার কার্যক্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মনজুর আলম: আমার সময়ে সিটি করপোরেশন ৯০০ কোটি টাকার কাজ করেছে। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা এসেছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে, বাকি ৪০০ কোটি টাকা সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় থেকে। আমি নির্বাচনের সময়ই বলেছিলাম, যেসব এলাকা অনুন্নত, সেসব এলাকার উন্নয়নকাজ আগে করব। আমি পাঁচ বছর কাজ করেছি। পাঁচ বছরে আমি তিন সপ্তাহের বেশি ছুটি নিইনি। প্রতিদিনই কাজ করেছি। আমি সংসদীয় রীতিতে সিটি করপোরেশন পরিচালনার চেষ্টা করেছি। নগরে জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় বাজেট ও লোকবল বাড়ানো হয়নি। সীমিত লোকবল ও সরঞ্জাম নিয়েই প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি। আরেকটি দিক হলো, আমার সময়ে সিটি করপোরেশন ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও নির্দলীয়। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনুসারী। আমরা একসঙ্গে কাজ করার সংস্কৃতির নজির স্থাপন করেছি।
প্রশ্ন: আজকের দিনে এসে নিজের সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি প্রসঙ্গে বলুন।
মনজুর আলম: মানুষের কাছ থেকে আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি, তার চেয়ে বড় পাওয়া আমার কাছে আর কিছুই হতে পারে না। দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে হৃদয়ে যে অনুভূতির সঞ্চার হয়, তা ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে শুধু নিজের কথা বললেই হবে না। মানুষের কথাও শুনতে হবে। যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে আমার সেবা করার সুযোগ হয়েছে, আমি সবসময় সততার সঙ্গেই তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে গেছি। ভবিষ্যতেও মানবতার সেবায় সেবামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখাই আমার স্বপ্ন।
সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা