রাজস্ব আহরণ বাড়াতে করজাল বৃদ্ধিসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব উদ্যোগের একটি আয়কর মেলা। মেলার পাশাপাশি আয়কর বিভাগের সংস্কার নিয়ে কথা বলেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান।
প্রশ্ন: কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) গ্রহণ ও কর প্রদান নিয়ে মানুষের মধ্যে একসময় ভীতি কাজ করত। বর্তমানে পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। কীভাবে এ পরিবর্তন আনলেন?
মো. নজিবুর রহমান: অতীতে কর দেয়ার প্রক্রিয়া ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সেবার ধরন যথেষ্ট করদাতাবান্ধব ছিল না। এ কারণেই মানুষ কর দিতে ভয় পেত। নিজের দেয়া করের টাকার সুফল দৃশ্যমান না হওয়াও সম্ভবত এর একটি কারণ। বর্তমানে সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এসেছে। এনবিআর কর্মকর্তারা এখন করদাতাবান্ধব। করদাতাদের সঙ্গে রাজস্ব কর্মকর্তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ‘বল প্রয়োগ নয়, সেবা’র মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের সংস্কৃতি চালু করেছে এনবিআর। করদাতাদের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে রাজস্ব আহরণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। তাই এখন আর এনবিআরকে কর আহরণ করতে হবে না। মানুষ নিজ থেকে আয়কর দেবে, এটাই যৌক্তিক।
প্রশ্ন: আয়কর থেকে মোট রাজস্বের ৩৭ শতাংশ আসছে। ২০২১ সালের মধ্যে একে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য আপনাদের। লক্ষ্যে পৌঁছতে এনবিআরের উদ্যোগগুলো কী?
মো. নজিবুর রহমান: আয়করের পরিধি বাড়াতে নতুন করদাতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে মানুষের মধ্যে কর সচেতনতা বৃদ্ধি, সামর্থ্যবানদের করজালের অন্তর্ভুক্ত করতে আইনি পরিবর্তন, করের টাকায় গৃহীত উন্নয়নকে মানুষের সামনে নিয়ে আসা, করদাতাদের সেবা প্রাপ্তি, আয়কর নিবন্ধন ও প্রদান সহজতর করাসহ নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করজাল বাড়াতে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আয়কর অফিস স্থাপন করা হচ্ছে। সব ইউনিয়ন পরিষদে অনলাইনে কর শনাক্তকারী নম্বর গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিবন্ধন নেয়া ও রিটার্ন পূরণে ডিজিটাল ব্যবস্থা করায় করদাতার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত দেড় বছরে নতুন করে প্রায় ১৩ লাখ করদাতা যোগ হয়ে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা এখন ৩১ লাখ ছাড়িয়েছে। আয়কর মেলা, আয়কর ক্যাম্প, আয়কর সপ্তাহ ও আয়কর দিবসের মতো ভিন্নধর্মী কর্মসূচিগুলোও লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হচ্ছে।
প্রশ্ন: গত কয়েক বছরে আয়কর মেলার পরিধি কয়েক গুণ বেড়েছে। তার পরও করদাতাদের জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগামীতে মেলার পরিসর নিয়ে কী ভাবছেন?
মো. নজিবুর রহমান: আগে ট্যাক্স ক্যাম্প করা হতো, যেখানে করবিষয়ক তথ্য দেয়া হতো। এখন আয়কর মেলা হচ্ছে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে হলেও এখন পরিধি অনেক বাড়ানো হয়েছে। সেবার মান ও পরিধি বাড়াতে এবার ঢাকাসহ ১৫১টি স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকায় এনবিআর নির্মাণাধীন নিজস্ব ভবনে ২০১৫ সালের তুলনায় প্রায় চার গুণ জায়গা নিয়ে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। তার পরও করদাতাদের স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না। এর নেপথ্যে রয়েছে করসংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় মানুষের আস্থা বৃদ্ধি। ভবিষ্যতে আয়কর মেলার পরিধি আরো বাড়ানো হবে। এনবিআরের নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে এখানেই সব আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেয়ার অনুরোধ থাকছে সরকারের কাছে।
প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত মেলা কতটুকু সফল?
মো. নজিবুর রহমান: আয়কর মেলা আয়োজনের পর শুরু থেকেই করদাতাদের করবিষয়ক তথ্যসেবা ও রিটার্ন পূরণে সহায়তা করে আসছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। ২০১০ সালে প্রথম আয়কর মেলায় ৬০ হাজার আয়করদাতাকে সেবার বিপরীতে ১১৩ কোটি টাকার কর আহরণ করে এনবিআর। গত বছরের মেলা থেকে আয়কর এসেছে ২ হাজার কোটি টাকা। তখন করসেবা নেন ৯ লাখ ২৯ হাজার করদাতা। এ বছরের মেলায় সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা ১২ লাখ ও আয়কর আদায় ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ বছরের মেলায় আগের মতোই করসেবা তথ্য, ই-টিআইএন নিবন্ধন, পুনর্নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, ই-পেমেন্টসহ সব সেবা পাওয়া যাচ্ছে। করদাতাদের শ্রেণীভেদে আলাদা বুথ খোলা হয়েছে। আয়কর মেলায় রিটার্ন দাখিল করলে প্রথমবারের মতো একটি স্মার্ট ট্যাক্স আইডি কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করছে এনবিআর। এটি করদাতাদের মধ্যে নতুন উদ্যমের সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন: আপনি এনবিআরের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কথা বলে আসছেন। সত্ করদাতাদের কীভাবে উত্সাহিত করছেন?
মো. নজিবুর রহমান: রাষ্ট্রের উন্নয়নে নাগরিকদের কাছ থেকে রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। দেশে ব্যবসা বা আয় করে দেশকে কিছু না দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রকে কর দেয়া সব সামর্থ্যবানের কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে যারা ফাঁকি দেবে, এনবিআর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। এনবিআর শুরু থেকেই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতিতে বিশ্বাসী। এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে ঢোকার সময়ই দেখবেন ফুল ও বাঘের প্রতিকৃতি। অর্থাত্ কর ফাঁকিবাজদের জন্য বাঘের গর্জন আর সত্ করদাতাদের জন্য ফুলেল শুভেচ্ছা। ভালো করদাতাদের উত্সাহ দিতে জাতীয় পর্যায়ে ট্যাক্স কার্ডের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে। জেলা পর্যায়ে সেরা করদাতাদের সম্মাননার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কর দেয়া একটি বাহাদুরি কাজ। ঘোষণা অনুযায়ী যেসব পরিবারের উপার্জনকারী সব সদস্যই কর দেন, সেসব পরিবারকে ‘কর বাহাদুর’ উপাধি দেয়া হচ্ছে। প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার দিতে এরই মধ্যে তালিকা প্রস্তুত করেছে এনবিআর।
প্রশ্ন: চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কিছু বলুন।
মো. নজিবুর রহমান: রাজস্ব আহরণে আমরা কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাজস্ব আহরণে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে রেকর্ড ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে করদাতা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করা হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা করদাতাদের সন্তুষ্ট করে রাজস্ব আহরণে পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন, তাদের পদোন্নতি ও পদায়নের মাধ্যমে প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নতুন নতুন উদ্ভাবনী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এনবিআর। আমাদের বিশ্বাস, বছর শেষে রাজস্ব আহরণে ভালো প্রবৃদ্ধি থাকবে। আবারো বলছি, আমরা এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইছি, যেখানে এনবিআরকে কর আদায় করতে হবে না, মানুষই সানন্দে কর দেবে।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা।