October 23, 2024 - 5:20 pm
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeধর্ম ও জীবনশবে মিরাজের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

শবে মিরাজের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য

spot_img

।। মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া আল ওয়াইসী-নক্সবন্দী-মোজাদ্দেদী ।।

লাইলাতুল মিরাজ অর্থাৎ মিরাজের রজনী, যা সাধারণ ভাবে শব-ই-মিরাজ নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মমতে, মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এই রাতে ঐশ্বরিক উপায়ে আকাশে আরোহণ করেন এবং আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।

ইসলামের ইতিহাস বলছে, হজরত মোহাম্মদের নবুওয়াত প্রাপ্তির ১১তম বছরের (৬২০ খ্রিস্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখ রাতে হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত্‍ করেন এবং পাঁচ বার নামাজ পাঠের হুকুম নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন তিনি। মিরাজ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। মহানবী (সা.) ছাড়া অন্য কোনও নবী এই পরম সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি।

আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আমাদের পিয়ারে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ব জাহানের অধিপতি মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন। এ কারণে শবে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী আধ্যাত্মিক তথা মারফত দর্শন রয়েছে।

আমরা জানি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসীম ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী। ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সব কিছু তারই সৃষ্টি। পৃথিবীর সৃষ্টিরাজির চেয়েও আরও কত বিস্ময়কর সৃষ্টি আছে, যা মানুষের চোখে দেখা তো দূরের কথা বরং কল্পনা করাটাও অসম্ভব। আর এই মেরাজ হচ্ছে, মহান আল্লাহতায়ালার কুদরতেরই অংশ বিশেষ। নবুওয়াতের ১০টি বছর অসহ্য নির্যাতন, নিপীড়ন-উৎপীড়ন, জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে ঘাত-প্রতিঘাত পারি দিবার পরে মহান আল্লাহ তার পিয়ারে হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে মেরাজের মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন, যা বিপদকে আনন্দ উল্লাসে এবং অপমানকে সম্মানে রূপান্তরিত করেছেন।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে মেরাজের ঘটনা এভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে, রজনী যোগে ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার চারপাশে আমি নানা ধরনের বরকত প্রদান করিয়া রাখিয়াছি, উদ্দেশ্য আমি তাহাকে স্বীয় আশ্চর্য ক্ষমতার কিছু নিদর্শন দেখানো। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহতায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহাবিশ্ব ভ্রমণ এবং দর্শনের কথা উলে­খ করেছেন।

শরিয়ত ও মারেফাতের দৃষ্টিতে মিরাজের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এর যেমন রয়েছে বাহ্যিক শিক্ষা তেমনি অভ্যন্তরীণ শিক্ষা। আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের অপূর্ব শিক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কের গভীরতা জানা যায়। এ জন্য ইলমে মারেফাতের জ্ঞান থাকতে হবে। অতি অল্প সময়ে মিরাজের বিস্তৃত ঘটনাবলী শরিয়তি হিসেবে মিলানো সম্ভব নয়। নিরাকার আল্লাহর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সশরীরে মোলাকাতের মাঝেও যে রহস্য, তা উদ্ঘাটনের জন্য ইলমে তাসাউফের জ্ঞান প্রয়োজন।

যথার্থ জ্ঞান না থাকায় অনেকে বলেন, নিরাকার আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। তারা মিরাজের ঘটনা পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে না। এমনকি রাসূল (সা.)-এর হাদিস, আস-সালাতু মিরাজুল মুমিনিন। এর মর্মার্থ না বুঝে নামাজে আল্লাহর সঙ্গে মিলনের কথাও মানে না। তারা নিজেরা মিরাজ করতে না পারার কারণে অন্য কেউ সেটা পারে তা মানতে নারাজ। ফলে তারা আল্লাহর নিকটতম জনের শান-মান সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নন। তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন না। যাদের অন্তর্চক্ষু নেই তারা বলে, নিরাকার আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়।

সূফী সাধকগণ যখন সাধনার মাধ্যমে আল্লাহকে পেতে চায়, তখন আল্লাহ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্নরূপে দেখা দিয়ে থাকেন। সাগরের পানি যেমন পৃথক হয়ে জলীয়বাষ্প আকারে বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান থাকে। এভাবে আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টির মধ্যেও বিরাজমান। আল্লাহ পাক আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানব জাতিকেই তার প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করেছেন। মানুষের কালবে আল্লাহ বিরাজ করেন। মহানবী রাসূল (সা.) বলেছেন, “মুমিন ব্যক্তির কালবেই আল্লাহর আরশ। সাধনার মাধ্যমে এক সময় মানুষ নিজের ভেতরের সুপ্ত নূরের সন্ধান পেয়ে যান।” সুফিদের ভাষায় যাকে পরম আত্মা বলে। মানুষের নফস যখন পরম আত্মার সঙ্গে মিশে যায় তখন দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।

আত্মজাগরণ বা কাশফ খোলার জন্য মুর্শিদের সাহচর্য গ্রহণ করা আবশ্যক। এর জন্য ধ্যান, জ্ঞান, মোরাকাবা, মোশাহেদা প্রয়োজন। তাই রাসূল (সা.) সর্বক্ষণ হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এ ধ্যান হতেই ইলমুল লাদুন্নীর উৎপত্তি। অলি আল্লাহগন ইলমুল লাদুন্নীর ধারক ও বাহক আর কেতাবি মাওলানারা শুধুই জাগতিক জ্ঞানের বাহক। মাদ্রাসা, মক্তবে ছাত্রদের কামেল, ফাজেল, আলেম, মাওলানা, মুফতি প্রভৃতি টাইটেল দিয়ে জাগতিক সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়। কিন্তু এক লাখ মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের একজনও মাদ্রাসার ধারে-কাছে যাননি। নবুয়তের যুগে মুমিনরা তাদের অভিভাবক নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহর সন্ধান পেয়েছিলেন। আর বেলায়েতের যুগে সাধকের জন্য অভিভাবক হচ্ছেন অলি-আল্লাহগণ।

এশকে ইলাহি বা আল্লাহ প্রেম লাভের জন্য কামেল মুরশিদের চরণে ফানা হতে হয়। মুর্শেদের চরণে ফানা হলে আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্যে পৌঁছানো যায়। মুর্শেদের সাহচর্য ও সান্নিধ্য ছাড়া আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব নয়। রাসুল নোমা হযরত সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.) অন্যতম খলিফা হয়রত জানশরীফ শাহ সুরেশ্বরী (রহ.) সিররেহক জামেনূর গ্রন্থে লিখেছেন, ” জাহেরি শরিয়তের যেখানে শেষ প্রান্ত ও পরিসমাপ্তি, ওখান থেকেই তরিকতের সূচনা ও শুরু। তাহলে যার শুরু ও সূচনা অন্যের শেষ প্রান্ত থেকে হয়, তার শেষ প্রান্ত কতই না মর্যাদাপূর্ণ।”

এ জন্যই মিরাজ শরিফের সফরে হজরত জিবরাঈল (আ.) বলেছেন- প্রক্যাত সূফী কবি ও সাধক হযরত শেখ সাদী (রহ.)’র ভাষায় : ‘আগার এক সারে মুয়ি বার তার পারাম/ ফরূগে তাজ্জলি বেসুযাদ পারাম।’ অর্থাৎ: “যদি আরেক চুল পরিমাণ পা বাড়াই/ তাজাল্লির আগুনে পাখা হবে ছাই।” এর তাৎপর্য হল, ওই মাকামে হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের প্রবেশের অধিকার নেই। তার এই ক্ষমতা নেই যে, জালালি মাকামের তেজস্বিতা নিজের আয়ত্তে নেবে বা ওই জগতের অবস্থা জানবে। এ জন্য তিনি অক্ষম হয়ে পড়েন। পবিত্র কোরআন মজিদে বর্ণিত হয়েছে, কাবা-কাওহাইনে আও আদনা’ অর্থাৎ আল্লাহ এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে ব্যবধান ছিল দুই ধনুকের মধ্যবর্তী মানে কোনো ব্যবধানই ছিল না।

শবে মেরাজের গুরুত্ব ও ফজিলত :
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বিশেষভাবে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি ২৭ রজব রোযা রাখবে সে যেন ৬০ মাসের রোযা রাখল।” একইভাবে ভাবে জলিল কদর সাহাবী হযরত আনাস (রা.) হতে বিশেষভাবে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি সাতাশে রজব ইবাদত করবে তার আমল নামায় একশত বৎসরের ইবাদতের সওয়াব লেখা হবে আর যে ব্যক্তি ঐ রাতে এ নিয়মে ১২ রাকাত নামাজ পড়বে যে, প্রত্যেক দু’রাকাতে সালাম ফিরাবে। অতঃপর যে কোন দুরুদবশরীফ ১০০ বার পড়ে দুনিয়ার জায়েজ যে কোন মাকছুদের জন্য দোয়া করবে আর পরের দিন রোযা রাখবে। আল্লাহ তায়ালা তার ঐ মাকছুদ পূর্ণ করবেন।” মিরাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাসুল (সাঃ) কে আল্লাহ তার মহিমার কীর্তিকলাপ দেখানো। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি হাবীবকে আমার কুদরতে কামেলার আশ্চর্য নিদর্শনসমূহ অবলোকন করানো। মহান আল্লাহ তায়ালা তার হাবীবকে অতীত নিকটে নিয়ে তাঁর নিদর্শনাদি বেহেশত, দোজখ, বেহেশতের নেয়ামত, দোজখের আযাব ও ফেরেস্তা আসমান, আরশ, কুরশী মালায়ে আলা প্রভুতি প্রত্যক্ষ করিয়ে দেয়ার জন্য এ মিরাজ শরীফের আয়োজন।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, “নবী কারীম (সা.) বলেন , “আমার কাছে একটি সাদা প্রাণী- বোরাক নিয়ে আসা হয় । যা গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চরের চেয়ে ছোট ছিল । ওটা ওর এক এক পদক্ষেপ এত দূরে রাখছিল যতদূর ওর দৃষ্টি যায় । আমি তাতে উঠে বসলাম । এবং ও আমাকে নিয়ে চললো। আমি বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছে গেলাম । এবং দরজার ওই শিকলের সঙ্গে বেধে রাখলাম যেখানে নবীগণ বাঁধতেন।”

” অতপর আমি মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি । যখন সেখান থেকে বের হলাম তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) আমার কাছে একটি মদ এবং একটি পাত্রে দুধ নিয়ে এলেন। আমি দুধ পছন্দ করলাম।” হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, “আপনি ফিতরাত (প্রকৃতি ) পছন্দ করেছেন।”

তারপর আমাকে প্রথম আকাশের দিকে নিয়ে যাওয়া হল এবং জিবরাঈল (আ.) দরজা খুলে দিতে বললেন। আর জিজ্ঞেস করা হলো আপনি কে ? উত্তরে বলা হলো, আমি জিব্রাইল। আবার তারা প্রশ্ন করেন আপনার সাথে কে রয়েছেন ? জবাবে জিব্রাইল বলেন আমার সাথে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো তার যাত্রা কি শুরু হয়েছে ? জিবরাইল আলাইহিস সালাম উত্তর দেন তার যাত্রা শুরু হয়েছে । তখন আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো । সেখানে হযরত আদম (আ.)এর সাথে সাক্ষাৎ হলো । তিনি মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের দোয়া করলেন । এরপর আমাকে দ্বিতীয় আকাশে নিয়ে যাওয়া হল এবং জিবরাঈল (আ.) দরজা খুলে দিতে বললেন । জিজ্ঞেস করা হলো আপনি কে ? উত্তরে বলা হলো! জিব্রাইল । আবার তারা প্রশ্ন করেন আপনার সাথে কে রয়েছেন ? জবাবে জিব্রাইল বলেন আমার সাথে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.)। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো তার যাত্রা কি শুরু হয়েছে ? জিবরাইল (আ.) উত্তর দেন তার যাত্রা শুরু হয়েছে । তখন আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। দ্বিতীয় আকাশে আমি হযরত ইয়াহহিয়াহ (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) কে দেখতে পেলাম । যারা একে অপরের খালাতো ভাই ছিলেন । তারা দুজন ও আমাকে মারহাবা বললেন এবং আমার কল্যাণের প্রার্থনা করলেন । তারপর আমাকে নিয়ে তৃতীয় আকাশে উঠে যান এবং ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) দরজা খুলে দিতে বললেন এবং প্রশ্ন করা হলো কে ? উত্তরে বলা হলো‌ জিব্রাইল । আবার তারা প্রশ্ন করেন আপনার সাথে কে রয়েছেন ? জবাবে জিব্রাইল বলেন আমার সাথে যিনি রয়েছেন তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.)। এভাবেই তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সবাই হুজুর (সা.)-কে অভ্যর্থনা জানান। সপ্তম আসমানে বায়তুল মামুরের কাছে ইবরাহিম (আ.) প্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন।

সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম (আ.) বায়তুল মামুর হেলান দেয়া অবস্থায় দেখতে পাই। বায়তুল মামুর এ প্রত্যহ ৭০ হাজার ফেরেশতা গমন করে থাকেন। কিন্তু একদিন যারা ওখানে যান তাদের পালা কেয়ামত পর্যন্ত আর আসবে না। তারপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে গাছের পাতা ছিল হাতির কানের সমান এবং ফল ছিল বৃহৎ মাটির পাত্রের মতো । ওটা আল্লাহ তাআলার আদেশ ডেকে রাখছিল । ওর সৌন্দর্যের বর্ণনা কেউ দিতে পারে না।তারপর আল্লাহ তাআলা আমার ওপর যে ওহী নাযিল করার তা নাযিল করেন।

এরপর আমার উম্মতের উপর দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। সেখান হতে নেমে আসার সময় হযরত মূসা (আ.) এর সাথে দেখা হয়। তিনি জিজ্ঞেস করেন আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে আপনার উম্মতের জন্য কি প্রাপ্ত হয়েছেন ? আমি উত্তরে বললাম দিনে-রাতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান। আপনার উম্মত দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার ক্ষমতা রাখে না। আপনার পূর্বে আমি বনী ইসরাঈলদের লোকদের দেখেছি যে তারা কেমন ছিল। সুতরাং আমি আমার রবের কাছে যাই এবং বললাম হে আমার রব ! আমার উম্মতের বোঝা কমিয়ে দিন। তারা এতটা পালন করতে পারবে না। সুতরাং তিনি পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দেন। এরপর আমি হযরত মূসা (আ.) এর কাছে ফিরে এলাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কি বলা হয়েছে ? বললাম আমার রব পাঁচ অক্ত কমিয়ে দিয়েছেন। এ কথা শুনে হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি আবার আপনাদের কাছে ফিরে যান। আপনার উম্মতের বোঝা কমিয়ে আনুন। এভাবে আমি আল্লাহ তা’আলা ও মূসা (আ.) এর মাঝে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম এবং প্রতিবার পাঁচ ওয়াক্ত করে সালাত কমিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অবশেষে তিনি বললেন, হে মুহাম্মদ (সা.) দিনে-রাতে মোট পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হলো এবং প্রত্যেকটি সালাতের জন্য দশগুণ সমাপ্ত করা হবে। সুতরাং এর মোট পরিমাণ পঞ্চাশে থাকলো। যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করার ইচ্ছা করলো অথচ তা সে করলো না তাহলে একটি ভাল কাজের আমল তার আমলনামা লিপিবদ্ধ করা হবে । আর যদি বাস্তবায়িত করে তাহলে দশটি আমলের সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। কোন ব্যক্তি যদি খারাপ কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে যদি ওটা না করে তাহলে তার আমলনামায় কোন পাপ লিপিবদ্ধ করা হবে না।

অতঃপর আমি নিচে নেমে আসি এবং হযরত মূসা (আ.) এর সাথে দেখা হলে তাকে এসব কথা বলি। তিনি বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে ফিরে যান । আপনার উম্মতের বোঝা কমিয়ে আনুন। তারা কখনোই আদেশ পালন করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু বারবার আল্লাহর কাছে আসা যাওয়ার পর তার কাছে আবার যেতে আমি লজ্জাবোধ করছিলাম ( আহমদ/১৩৪৮ মুসলিম/ ১১৪৫ )

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত।‌মিরাজের রাতে ঊর্ধ্ব গমনের জন্য বোরাকের লাগাম এবং জিন বা গদি প্রস্তুত করে রাখা ছিল। নবী কারীম (সা.) সাওয়ার হওয়ার সময় সেটা ছটফট করতে থাকে । তখন জিবরাঈল (আ.) তাকে বললেন, “তুমি এটা কি করছো ? আল্লাহর শপথ তোমার উপর ইতোপূর্বে তার চেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কখনো সাওয়ার হয়নি । একথা শুনে বোরাক সম্পূর্ণরূপে শান্ত হয়ে যায়। ( তিরমিজি/ ৩১৩১ )”

ঊর্ধ্বজগতে যেসব নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, তারাও বিদায় সংবর্ধনা জানানোর জন্য তার সঙ্গে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত আগমন করেন। তখন নামাজের সময় হয়ে যায়। জিবরাইল (আ.)-এর ইঙ্গিতে নবীজি (সা.)-কে ইমাম বানানো হয়। তিনি নবীদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। এরপর বুরাকে সাওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কা মুকাররমায় পৌঁছে যান। (মা’আরেফুল কোরআন : ৭৬৪-৭৬৫)

হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, মিরাজের ব্যাপারে কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা প্ৰতিপন্ন করতে চেষ্টা করল তখন আমি কাবার হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আর আল্লাহ বাইতুল মাকদিসকে আমার সামনে উদ্ভাসিত করলেন। ফলে আমি তার দিকে তাকিয়ে তার চিহ্ন ও নিদর্শনগুলো তাদেরকে বলে দিতে থাকলাম। ( সহীহ বুখারী, ৩৮৮৬)

পৃথিবীর সময় ও কাজকর্ম সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ। তার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। যখন মহানবী (সা.) এসে এই মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কোনো প্রশ্ন ও যুক্তিতর্ক ছাড়াই বিশ্বাস করে নিলেন। আর এ কারণে মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)কে ‘সিদ্দিক’ বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন, বর্তমানে মিরাজ নিয়ে তেমন কোনো তর্ক পরিলক্ষিত হয় না। কারণ বর্তমানে বিজ্ঞানের এই সভ্যযুগে শুধু মুসলমানই নয় বরং বিধর্মীরাও এটা স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ আজ মানুষ বিজ্ঞানের দ্বারা সৌরজগৎ ভেদ করে চন্দ্র ও মঙ্গলগ্রহে পদার্পণ করছে। আর মহাবিশ্বের স্রষ্টার কুদরতের মাধ্যমে তার প্রিয় হাবিবকে দিদার করানো অসম্ভব নয়, বরং সম্ভব ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ আল্লাহর নিকট অসম্ভব বলতে কিছু নেই। মহান আল্লাহ সূরা হাদিদের ৩নং আয়াতে বলেন, ‘তিনিই আদি, তিনিই অনন্ত, তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই সুপ্ত এবং তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত।’ পবিত্র বাইবেলে উলে­খ আছে, ‘সৃষ্টির প্রারম্ভে আলোক ছিল, প্রচুর আলোক ছিল।’ ইহাতেও প্রমাণিত হয়, সবকিছু একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি; তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করতে পারেন।

মিরাজের প্রথম দর্শন হচ্ছে মারেফত বা তাসাউফ সম্পর্কীয়। আল্লাহর দিদার এবং সান্নিধ্য লাভ করে আমাদের বিশ্বনবী (সা.) মারেফত তথা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সফলতার সৌভাগ্যের শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এখানে স্বরণ রাখা দরকার, মহানবী (সা.) আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ করে, তিনি সমাজবিমুখ বা মজবুত তন্দ্রাগ্রস্ত হন নাই। বরং মাটির পৃথিবীতে ফিরে এসে দ্বীনি দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। মেরাজের পরেই তিনি হিজরত করেন।

পবিত্র শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মসজিদ, খানকা ও মহল্লায় মহল্লায় বিশেষ মিলাদ মাহফিল আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। যা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে আমরা মনে করি। মনে রাখতে হবে, ফরজ ও সুন্নত ইবাদতের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। যা নবী (সা.) সাহাবা আজমাইন ও ওলি-আওলিয়াদের জীবন থেকে জানা যায়। এবারের পবিত্র শবে মেরাজ আমাদের সবার জন্য বয়ে আনুক সুখ, সমৃদ্ধ ও দেশের জন্য সার্বিক কল্যাণ, এটিই আমাদের একান্ত কামনা।

শবে মেরাজের এ সফর ছিল বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর একান্ত সাক্ষাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে ঘটে যাওয়া আলৌকিক ঘটনার অন্যতম একটি নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মহানবী (স.)-এর মেরাজের প্রতি বিশ্বাসে অটল-অবিচল রাখুন। মেরাজে পাওয়া তোহফা নামাজকে যথাযথ কায়েম করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

[ লেখক : পরিচালক , আল ইউনুসীয়া-ওয়াইসীয়া দরবার শরীফ, শিবপুর, নরসিংদী]

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ

দুর্নীতির মামলায় খালাস পেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর

কর্পোরেট সংবাদ ডেসক্ : সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান...

সিলেটে চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্ম বিরতি

সিলেট প্রতিনিধি : সিলেটে চা শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্ম বিরতি ডাক দিয়েছে এনটিসি শ্রমিকরা। মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) বেলা ১১ট থেকে সিলেট লাক্কাতুরাসহ রাষ্ট্রীয়...

মোবাইল কিনতে শিশুকে অপহরণের পর হত্যা, কাকাসহ ২ জনের যাবজ্জীবন

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় মেহেরাজ হোসেন ওরফে জিসান (৭) নামে এক শিশুকে অপহরণ করে হত্যার দায়ে ২জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সাথে...

শার্শায় সাজাপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি গ্রেপ্তার

মনির হোসেন, বেনাপেল প্রতিনিধি: যশোরের শার্শা থানার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তসহ পরোয়ানাভুক্ত‌ পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার (২৩ অক্টোবর) ভোররাতে শার্শা থানার...

১১ ঘণ্টা পর খুলনার সঙ্গে রেলযোগাযোগ স্বাভাবিক

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আনসার বাড়িয়া রেলস্টেশনের নিকট তেলবাহী ট্রেনের আটটি ট্যাঙ্কার লাইনচ্যুতের ঘটনার দীর্ঘ ১১ ঘন্টা পর স্বাভাবিক হয় খুলনা থেকে সারাদেশের...

ন্যাশনাল মোবাইল ফটোগ্রাফি কনটেস্ট-২০২৪ এর আয়োজন করেছে রিয়েলমি

কর্পোরেট ডেস্ক: বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি প্রেমীদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য দারুণ এক সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে তরুণদের জনপ্রিয় স্মার্টফোন ব্র্যান্ড রিয়েলমি। মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডটি...

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’: হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ

নোয়াখালী প্রতিনিধি: পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ এ পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে...

ক্রিপ্টোকারেন্সিকে আক্রমণের প্রচেষ্টা লাজারাস এপিটির

কর্পোরেট ডেস্ক: ক্যাসপারস্কির গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস টিম (গ্রেট) বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগকারীদের লক্ষ্য করে লাজারাস অ্যাডভান্সড পার্সিস্টেন্ট থ্রেট (এপিটি) গ্রুপের পরিকল্পিত একটি ক্ষতিকর ক্যাম্পেইন...