January 28, 2025 - 9:24 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeনির্বাচিত কলামকক্সবাজারবাসীদের এক জীবনে অনেক জীবন

কক্সবাজারবাসীদের এক জীবনে অনেক জীবন

spot_img

আবুল মনজুর মোঃ সাদেক।। দশ নভেম্বরের রাত। কক্সবাজারের সমুদ্রের ধারে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। এগার তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে রেললাইন, আইকনিক রেলস্টেশন, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এলজিইডি নির্মিত কক্সবাজার শহরের সাথে বাঁকখালী নদীর উপর ৫৬৫ মি দীর্ঘ একটি সেতু উদ্বোধন করবেন। এর সাথে এলজিইডি এবং অন্যান্য সংস্থার আরো প্রায় ১৫টি প্রকল্প/স্কীমের উদ্বোধন/ভিত্তিপ্রস্তর রয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের সিনিয়র অনেক কর্মকর্তা এখন কক্সবাজারে। সাগরের ধার ঘেঁষে গড়ে উঠা এ রেস্টুরেন্টে এদের মধ্যে অনেকেই এসেছেন। আমাদের কিছু সহকর্মীরাও আছেন ।

এই রেস্টুরেন্ট কয়েকজন গায়ক নিয়ে আসা হয়েছে। মাঝবয়সী মানুষ বেশি দেখলে যা হয়, গায়করা হারানো দিনের গান শুরু করে। হারানো দিনের গান থেকে ক্রমশঃ আধুনিক গানে এগোচ্ছে। একজন আঞ্চলিক গানের অনুরোধ করলেন। গায়ক ‘ওরে সাম্পান ওয়ালা, বুকের ভেতর বান্ধি রাইখুম তোয়ারে’ গানে ফিরে গেলেন। ‘ওরে নীল দরিয়া, সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে’ – সাগর নিয়ে বাংলা সিনেমার বিখ্যাত গানগুলো গাইতে লাগলেন।

আমি স্মৃতির ভেতর বারবার ডুবে যাচ্ছি। ভাসছি, আবার স্মৃতি কাতর হচ্ছি।

সাগরপাড়ে বাহারছড়া গ্রামে আমার বেড়ে উঠা। বাবা ছিলেন পিটিআই এর সুপারিন্টেন্টেন্ড। সাগর পাড়ের কাছাকাছি সরকারি বাসায় থাকতাম। বাসা থেকে বেরিয়ে দু’শগজ হাঁটলেই পর্যটনের একতলা বেশ কয়েকটি কটেজ ছিল। চারশ গজ হাঁটলে পুরানো হোটেল সায়মন। এখন সেখানে বহুতল ভবন হয়েছে। সাইমনের বেকারীতে রুটি-বিস্কিট আনতে গিয়ে স্যুটিং পার্টির সাথে দেখা হয়ে যেতো। কখনো ভাগ্যক্রমে বড় নায়ক, নায়িকাদের দেখতে পেতাম। বাসার পাশের বড় সড়কটিই ছিলো ‘মোটেল রোড’। মোটেল রোডে শীতকালে পিকনিকের বাস আর মাইকের গান শৈশবের একটি বড় অংশ জুড়ে থেকে গেছে। সত্তর আশির দশকে হোটেল- মোটেল ছিল খুবই কম। বিভিন্ন স্কুল কলেজের পর্যটকরা কক্সবাজারের স্কুল কলেজের বেঞ্চে রাত পার করতেন। সাথে বাজার-বাবুর্চি, হাড়িপাতিল নিয়ে আসতেন। এত কস্ট করে আসা-তবু সমুদ্রের জলে সব কস্ট ধুয়ে মুছে সমুদ্রের ফেনায় নিজেদের ভেতর বাইর ভিজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

গতকাল রেল লাইন প্রকল্পের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার নিয়ে তাঁর কৈশোরের গল্প বললেন। বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকলে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার আসার চেষ্টা করতেন। ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার কক্সবাজার আসেন। ‘মোটেল’ এ থাকতেন, মোটেলের সাথে কিচেন ছিল। নিজেরা রান্নাবান্না করে খেতেন। ৬১’এর পর বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের ফাঁকা সময়টায় বাবার সঙ্গে আরও কয়েকবার এসেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতিতে কক্সবাজার নিয়ে বড় একটা জায়গা আছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আবেগ এবং কক্সবাজারের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে আর্ন্তজাতিকমান, স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্য তাঁর অদম্য আগ্রহ।

কক্সবাজার বদলে গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরেই। কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের এক একটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে খোলা জীপ-চাঁদের গাড়িতে করে স্যুটিং পার্টি এবং অ্যডভ্যাঞ্চারাস পর্যটকরা হিমছড়ি, ইনানীর দিকে যেতেন। ৯০এর দশক থেকে মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প শুরু হলেও বারবার অগ্রগতি থমকে গেছে। ১৯৯৬ এর সরকারে এসে এবং পরে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছায় মেরিন ড্রাইভ এর কাজ শেষ হয়েছে। গতকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘পৃথিবীতে দীর্ঘ সৈকত হয়তো আছে কিন্তু ৮০ মাইল দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত আর নেই। সৈকতের পুরো দৈর্ঘ্যই উপভোগ্য, এমন সৈকত পৃথিবীতে বিরল। জাপানেও দীর্ঘ সৈকতগুলোতে ঘুরেছি। কিন্তু কাঁদামাটির সৈকত বলে সহজে নামা যায়নি। নেদারল্যান্ডসেও একই অবস্থা। স্পেন, পর্তুগালে বালুকাময় সৈকত আছে কিন্তু এতো দীর্ঘ নয়।’

এ রকম একটা পৃথিবীখ্যাত সৈকত বেলাভূমি। পৃথিবীর কাছে সহজে উম্মুক্ত করার উপায় কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে, বিমানবন্দর সম্প্রসারিত হয়ে আর্ন্তজাতিক হয়েছে। সাগর ছুঁয়ে বিমান নামার সে স্বপ্ন দ্রুতই বাস্তবায়িত হবে। সাগরের একটি অংশ পুনুরুদ্ধার করে রানওয়ে নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এতদিন, বালি দ্বীপ দেখে ভাবতাম -আমরাও কী এরকম পারি না!

চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো, কক্সবাজারের দুঃখ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কপথ। সেই ৮১ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ঘর ছাড়ি। শৈশব থেকেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক পথ স্বস্তি নিয়ে আসেনি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে- কিন্তু কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা এগোচ্ছে না, এই দুঃখ কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের। এবছরের শুরুর দিকে এই সড়কেই একটা ভয়াবহ দূর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে আহত হয়েছি আমি। আমার মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়তই এই সড়ক সথে দূর্ঘটনায় পড়ছেন।

অথচ বৃটিশ ১৮৯০ সালেই কক্সবাজারের সাথে রেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলো। পাকিস্তান আমলে ও আরেকবার পরিকল্পনা হয়েছে কিন্তু কাজ আর হয়নি। বিগত ১৩৩ বছরের ব্যর্থতাকে জয় করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে হাল ধরে এবার কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উম্মুক্ত করে দিলেন। যে কোন পর্যটক রাতে ঢাকা থেকে উঠে সকালে আইকনিক রেল স্টেশনে নেমে দেখবে, একটি ঝিনুক তার জন্য আধফোঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কক্সবাজার নয় বিগত ১৫ বছরে রেলপথ সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় সারাদেশে। শুধু বরিশাল যাওয়া বাকি আছে মাত্র।

কক্সবাজার শহরটা পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি এক সড়কের শহর ছিল। দক্ষিণে পাহাড়, উত্তরে বাঁকখালী নদী। এ শহরটা দিনে দিনে বড় হয়েছে। জনসংখ্যা অনেকগুণ বেড়েছে। বাইপাস সড়ক হয়েছে। বসতি ঘন থেকে ঘন হয়েছে। কিন্তু শহরটি সম্প্রসারিত হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহে, বাঁকখালী নদীর উপর খুবই দৃষ্টিনন্দন ৫৬৫ মিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি। এর ডিজাইনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখে অনুমোদন করেছিলেন। সাগরের মোহনার কাছাকাছি এই ব্রিজ নির্মাণে অনেক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এলজিইডি এই অধ্যায়গুলো অতিক্রম করেছে।

জাপান সরকারের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। একটি দু’মাসের প্রশিক্ষণে ২০০৯ সালে এবং পরে সরকারি কাজে আমি কয়েকবার জাপান এবং জাইকা সদর দপ্তরে গিয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাপী যে অনন্য ভাবমুর্তি-জাপান এবং জাইকা সদর দপ্তরে তা সহজেই বোঝা যায়। জাইকা এখন মাতারবাড়ি মহেশখালী বদলে দিচ্ছে। কক্সবাজার হয়ে যাচ্ছে দেশের গোটা অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। কক্সবাজার পৌরসভায়ও জাইকা’র সিটি গর্ভনেন্স প্রকল্প শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন করছে এলজিইডি এবং পৌরসভা। কক্সবাজারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ শহরটা বদলে যাবে।

আমি প্রায়ই আশ্চর্য হয়ে ভাবি, বিগত পনের বছরে দেশটা কীভাবে পাল্টে গেলো! একজীবনে আমরা যেন পার করলাম অনেক জীবন আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজীবনে কোটি কোটি মানুষের জীবনে আশার ফুল ফোটাচ্ছেন। আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ, মধ্য আয়ের দেশ, উন্নত দেশ-স্মার্ট বাংলাদেশ, সোনার বাংলা। আমাদের স্বপ্নগুলো জিইয়ে থাক।

দয়াময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নেক হায়াত এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি দান করুন -এই কামনা আমার চিরদিনের চিরকালের।

লেখকঃ প্রকল্প পরিচালক বৃহত্তর চট্টগ্রাম গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩, এলজিইডি।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ

সিংগাইরে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : মানিকগঞ্জের সিংগাইরে নয়াপাড়া-ভূমদক্ষিণ যুব সংঘের আয়োজনে ব্যাডমিন্টন সিজন-৩ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (২৭ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৮ টার দিকে উপজেলার...

প্রথম ধাপে মালয়েশিয়া যেতে পারবেন ৭ হাজার ৯৬৪ জন

কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক: গত বছর বাংলাদেশের প্রায় ১৮ হাজার কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় তারা আটকে যান। তবে তাদের মধ্যে ৭ হাজার...

বগুড়ায় ডাকাতি প্রস্তুতিকালে গ্রেপ্তার ১

বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ার আদমদীঘিতে ডাকাতি প্রস্তুতিকালে পিয়াস মন্ডল (৩১) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসময় তার কাছে থেকে ডাকাতির প্রস্তুতির সরঞ্জাম রশি, চাপাতি,...

যারা ক্ষমতামুখি হয়েছেন, তাদেরকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে: চুয়াডাঙ্গায় হাসনাত আব্দুল্লাহ

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, 'কাদের কাদের আওয়ামী লীগের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো আমাদের জানা আছে। কেউ কেউ...

আমাকে দেখলে তো ৩০ বছরেরই মনে হয়: শাহরুখ খান

বিনোদন ডেস্ক: জন্ম ১৯৬৫ সালে। অর্থাৎ, এ বছর শেষ হওয়ার আগেই ৬০ বছরে পা দিবেন বলিউডের বাদশাহ শাহরুখ খান। ভারতে চিহ্নিত হবেন প্রবীণ নাগরিক...

স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ব্যবসায়ী কারাগারে

বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়ার ধুনট উপজেলায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে রকিবুল হাসান রকি তালুকদার (২৮) নামে এক ব্যবসায়ীকে সোমবার (২৭ জানুয়ারি)...

স্মার্ট ও স্বাস্থ্যকর রান্নার সমাধানে বাজারে এলো স্যামসাংয়ের ৬টি মাইক্রোওয়েভ ওভেন

কর্পোরেট ডেস্ক: বেকিং, গ্রিল সহ নানা স্টাইলের রান্না নিয়ে শৌখিন হতে এখন আর বাধা নেই, কারণ স্যামসাং সম্প্রতি বাজারে নিয়ে এসেছে তাদের সবচেয়ে আধুনিক...