ময়মনসিংহ ব্যুরো: ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় ২৬৫ বছর যাবত চলতে থাকা ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা বন্ধ ঘোষণা করছে প্রশাসন। খেলাটি বন্ধ করতে গত রাত থেকে তৎপরতা চালিয়েছে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) রাত পৌনে ১২টার দিকে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুকনুজ্জামান এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে ২৬৬তম হুমগুটি খেলা উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের দশমাইল এলাকায় হওয়ার কথা ছিল। এই খেলায় বিশৃঙ্খলা ঘটে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে খেলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। সে অনুযায়ী সোমবার রাত থেকে খেলা বন্ধ করতে তৎপরতা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ। রাতে খেলার মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন।
ওসি বলেন, খেলার আয়োজক এবি সিদ্দিক। তাকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খেলা বন্ধ রাখতে তার পরিবারের মাধ্যমে জানানো হয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে খেলার চেষ্টা করা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফেরাতে চেষ্টা করবে। তবুও খেলা চালানো হলে, এর মাধ্যমে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে দায়ভার তাদের নিজেদেরকেই নিতে হবে।
গত বছর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ইআটা বিলে ২৬৫তম খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আজব এ খেলায় প্রতিবছর দলবেঁধে খেলার নির্ধারিত এলাকায় আসেন হাজারো খেলোয়াড়সহ লক্ষাধিক দর্শনার্থী। দুপুর থেকে খেলা শুরু হয়। কোনো বছর সন্ধ্যায়, কোনো বছর রাতে, আবার কোনো বছর পরদিন কিংবা কয়েকদিন পরে খেলা শেষ হয়।
জনশ্রুতি আছে, মুক্তাগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায় জমি পরিমাপের বিরোধ সমাধানে তাদের প্রজাদের মধ্যে কৌশল ও শক্তির খেলা হিসেবে বৃত্তাকৃতির বল ‘হুমগুটি’ খেলার আয়োজন করেছিলেন। দুই জমিদারের সীমানা তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে ধানের পতিত জমিতে এর আয়োজন করা হয়।
খেলার শর্ত ছিল যে জমিদারের প্রজারা প্রায় ৪০ কেজি ওজনের এক পিতলের বলকে নিতে পারবেন সেই জমিদারের জমির পরিমাপ হবে সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। পরাজিত জমিদারের এলাকার জমির পরিমাপ হবে ১০ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রজারা খেলায় বিজয়ী হন। এরপর থেকে জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর ‘পরগনা’ এলাকায় জমির পরিমাপ হয় সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের এলাকার ‘তালুক’ জমির পরিমাপ হয় ১০ শতাংশে এক কাঠা।
সেই রেওয়াজ মেনে এখনো প্রতিবছর খেলার আয়োজন করা হয়। খেলোয়াড়রা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলতে শুরু করেন। টেনেহিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে যে বা যারা এই গুটি গুম করে ফেলতে পারবেন, তারাই বিজয়ী।
খেলার দিন সকাল থেকে জেলার ফুলবাড়ীয়া, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের তালে হাজারো খেলোয়াড়রা আসেন। ধীরে ধীরে দর্শনার্থী হয় লক্ষাধিক। এদিন গুটি খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামে মেলা বসে।
ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকার স্বপন, জামাল উদ্দিন ও আল আমিনসহ কয়েকজন জানান, এ খেলাকে কেন্দ্র করে উপজেলার গ্রামগুলোতে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। প্রতিটি বাড়িতে চলে আত্মীয়-স্বজনদের মিলনমেলা। পিঠাপুলি, পায়েস আর নানা ধরনের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় অতিথিদের। এই উপজেলার মানুষ ‘হুমগুটি’ খেলাকে ঈদের আনন্দ মনে করে। তবে সবাই চাচ্ছে এবারও খেলাটি শুরু হোক। তবে সেটি যেন হয়, শান্তিপূর্ণভাবে।