সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের বিসিক শিল্প পার্কের নিম্নমানের কাজ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর চলছে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা। নিম্নমানের ইট-খোয়ার ব্যবহার, রাস্তার কার্পেটিং এ কারসাজি, হেরিংবন্ডে অর্ধাংশ ইটের ব্যবহারসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও নীরব ভূমিকা পালন করছে বিসিক কর্তৃপক্ষ। শাস্তির বিপরীতে ঠিকাদারের যোগসাজসে দ্রুত নিম্নমানের কাজ শেষ করে বিল দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিসিক কর্তৃপক্ষ। এদিকে অনিয়ম ঢাকতে কাজের সঠিকতা ও প্লট বরাদ্ধের কাজ এগিয়ে চলছে মর্মে বিভিন্ন সংবাদে প্রকাশ হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আরও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত’। ২৭ জুনের মধ্যেই বিল নিতে হবে। এর মধ্যে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করতে হবে। অল্প কিছু কাজ থাকলেও পরে করে নেওয়া যাবে। এর মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে, প্রকল্প শেষ হবে না। কাজ না করলে ঠিকাদারা বিলও পাবেন না।
আরো জানা যায়, একাধিকবার সংশোধনের সময় প্রকল্পের খরচ ৩ গুন বেড়েছে। তবে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করার কথা ছিল। পাশাপাশি প্রকল্পের সময় আর না বাড়ানোর সুপারিশও করেছে। এই সুযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাজ করছে বলে অভিযোগ উঠে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিম্নমানের ছবি প্রকাশে অভিযোগ করে বলেন, যথাযথ পরীক্ষা না করেই শুধু কাগজে-কলমে টেস্ট করে হচ্ছে কাজ। তদন্ত হলেই বেরিয়ে আসবে অনিয়মের নানান দিক।
নিম্নমানের কাজ নিয়ে এর আগে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের প্রকৌশল ও প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগের পরিচালক আব্দুল মতিন। নিম্নমানের কাজের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, কিছু নিম্নমানের কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্যও পাচ্ছি। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানান তিনি। তার এমন বক্তব্যের পর গত বুধবার (১৯ জুন) সরেজমিনে বিসিক শিল্প পার্ক প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। টেন্ডার শর্ত ভেঙ্গে নিম্নমানের কাজ এখনও চলমান। প্রকল্প কাজে ৫০ মিঃলিঃ সাইজের খোয়া ধরা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ ইটের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে তার চেয়ে বড় সাইজের। এছাড়া কার্পেটিংয়ের কাজ ৭৫ মিঃলিঃ ধরা থাকলেও কোথাও ৬০ মিঃলিঃ থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ মিঃলিঃ কার্পেটিং করা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয়রা সাব-বেজ মান নিয়ে নানা অভিযোগ করে বলেন, এখানে বড় মাপের খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। খোয়ার চেয়ে বালুর ব্যবহার বেশি। প্রকল্প এলাকায় ভরাটকৃত বালু দিয়েই হচ্ছে সাব-বেজের বালুর কাজ।
গত ২ জুন বিসিক শিল্প পার্ক প্রকল্প নিয়ে একাধিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। যেখানে হেরিংবন্ডে নিম্নমানের অর্ধাংশ ইট ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণ, নিম্নমানের ইট দিয়ে খোয়া তৈরিসহ প্রকল্প কাজে নানান অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।
জানা যায়, ড্রেন নির্মাণ কাজ করছে আরাফাত কনষ্ট্রাকশন নামের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তার অবকাঠামো জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে নির্মাণ করছে বিডিইএল এমএ ও আরাফাত কনষ্ট্রাকশন। যদিও উভয় কাজই একই মালিক বাস্তবায়ন করছে বলে জানা গেছে।’
প্রকল্প এলাকার আশেপাশে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, নিম্নমানের কাজের বিষয়ে ভয়ে কিছু বলতে পারি না। কার্পেটিংয়ের মালামালও খারাপ। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে। কিন্ত তদন্ত করবে কে? শুনছিলাম তদন্ত হবে, সেটা আর হবে কবে? যাদের দেখার কথা তারাইতো চুপ আছে! বিসিকের প্রশ্রয় আছে বলেইতো নিম্নমানের কাজের পরও ব্যবস্থা নেয় না।
এ বিষয়ে আরাফাত কনষ্ট্রাকশনের সত্ত্বাধিকারী আরাফাত হোসেন জানান, আমরা ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করেছি। কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে না। জুনেই সব কাজ শেষ করে ফেলব। সাইটে কোনো সমস্যা থাকলে, তিনি বিসিক শিল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। নিম্ন মানের খোয়া ও ইট নিয়ে কথা বলতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করেন। টেন্ডারে হেরিংবন্ডে অর্ধাংশ ইট ব্যবহারের শর্ত না থাকলেও, এমন ইট থাকতেই পারে বলে জানান। কোনো সমস্যা থাকলে তিনি বিসিক শিল্পনগরী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীর সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও বিসিক শিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাফর বায়জিদ ঠিকাদারের সূত্র ধরে তিনি জানান, প্রকল্পটি জুনেই শেষ করতে হবে, এজন্য দিন রাত কাজ চলছে। নিম্নমানের ইটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে নিম্নমানের ইট নেই, যা ছিলো কয়েক ট্রাক ইট ফেরত দিয়েছি। অর্ধাংশ ইটের ব্যাপারে জানান, এটা ব্যবহারের অনুমতি নেই। তবে আমার সব রাস্তার তদারকি সম্ভব না। কার্পেটিংয়ের কাজ ৭৫ মিঃলিঃ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ৩৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্প হাতে শিল্প মন্ত্রণালয়। পরে প্রথমবার সংশোধনের পর প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে ৪৮৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা করা হয়। সময় বাড়ানো হয় ২০১৫ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পটি আরও দুইবার সংশোধন করা হয়। খরচ বাড়িয়ে প্রথমে ৬২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা ও পরে ৭১৯ কোটি ২১ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের সময় একবার ২০১৯ সালের জুন ও পরে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। একাধিকবার সংশোধনের সময় প্রকল্পের খরচ ৩ গুন বেড়েছে। তবে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে, পাশাপাশি প্রকল্পের সময় আর না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। শিল্পপার্কটি সিরাজগঞ্জের সায়েদাবাদ ও কালিয়া হরিপুরে ৪০০ একর জায়গায় নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। শিল্প পার্কটিতে ৮২৯টি প্লটে ৫৭০টি কারখানা স্থাপন করা হবে।’