যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি এবং তাঁর নীতি ঘোষণা করে পৃথিবীজুড়েই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। বলেছেন, চীন ও মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করা হবে। কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করবেন। ট্রাম্পের এসব ঘোষণায় বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে কথা বলেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
প্রশ্ন: ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়ে যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আহসান এইচ মনসুর: নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প যেসব বিবৃতি দিয়েছেন, বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত নীতি ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেহেতু তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন, তাই এখন এ প্রশ্নই সামনে চলে এসেছে—তিনি যা বলেছেন, তা আদৌ বাস্তবায়ন করবেন কি না বা করতে পারবেন কি না? তবে আমি মনে করি, তিনি যা বলেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বিশ্ব যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এত সহজে তিনি তাঁর নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না।
প্রশ্ন: ট্রাম্প তো ঘোষণা দিয়েছেন, অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করে দেবেন। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক তো সেখানে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাহলে ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কারণ নয় কি?
আহসান এইচ মনসুর: অভিবাসীদের বিষয়ে ট্রাম্প অত্যন্ত স্পষ্ট ও রূঢ় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। যদিও ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীবান্ধব রাষ্ট্র। অভিবাসী রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে উপকৃতই হয়েছে। তাই সেখানে ট্রাম্পের এ নীতি কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এটি করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আসবে, যা দেশটির জন্যও মোটেই সুখকর হবে না। আজকের যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের পেছনে অভিবাসীদেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
প্রশ্ন: অভিবাসীবান্ধব যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব তৈরি হলো কেন?
আহসান এইচ মনসুর: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে শুরুতে অভিবাসনের মাধ্যমে ভালো সুবিধা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন এসে বিশ্বায়নের বাণিজ্য-সুবিধার অনেকাংশে চলে যাচ্ছে অনুন্নত দেশগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় কোম্পানি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে দেশটিতে চাকরির সুবিধা কমছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মঠ শ্রমিক শ্রেণির চাকরির সুবিধা যেমন কমেছে, তেমনি প্রকৃত অর্থে মজুরি বাড়েনি। বিশ্বায়নের মাধ্যমে দুটো বিষয় ঘটেছে—একদিকে বাইরে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে চাকরির সুবিধাগুলো বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে গেছে। দুই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের আয় কমেছে, জীবনযাত্রার মানও কমেছে। ফলে ওই শ্রেণিটি নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছে এবং তাদের মধ্যে বিশ্বায়নবিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইউরোপের ব্রেক্সিটে ও যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে। ছোট ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের লোকের মধ্যে এ ক্ষোভ ছিল প্রবল।
প্রশ্ন: এ কারণেই কি ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন?
আহসান এইচ মনসুর: যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় অংশের (যাঁরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন) মনোভাব বুঝতে পেরে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে সেটিকে কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু এখন এসে বিশ্বায়নকে অস্বীকার করার ঘোষণাকে কার্যকর করা ততটা সহজ হবে না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বহুজাতিক কোম্পানি সারা বিশ্বে নিজেদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে, তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। তারাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের মূল চালিকাশক্তি। তারা চায় বিশ্বজুড়ে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে। তাই তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘোষণা সাংঘর্ষিক। সেখানে এককভাবে তাঁর মতামতগুলো কার্যকর করা খুব কঠিন হবে।
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের জিএসপি (অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা) ইস্যুটি ঝুলে আছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় এটি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা কি আছে?
আহসান এইচ মনসুর: জিএসপি ভাগ্য খুলবে কি খুলবে না, এটা নিশ্চিত করে এখনই বলা মুশকিল। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, তাতে মনে হয় না বাংলাদেশ বিষয়ে ট্রাম্পের নিজস্ব রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা আছে। বাংলাদেশ নিয়ে তিনি কতটা ওয়াকিবহাল, সেটিও জানা যায়নি। সে ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, জিএসপির ক্ষেত্রে হয়তো ট্রাম্পের রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা কাজ করবে না। প্রশাসনিকভাবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদ্যোগ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। সেদিক থেকে এ ইস্যুটিকে হয়তো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার একটা সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন। সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন?
আহসান এইচ মনসুর: ১৯২৯-৩০ সালে বিশ্বজুড়ে মহা মন্দা দেখা দিয়েছিল। সে সময় বেশির ভাগ রাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ‘বেগার দ্য নেভার’। অর্থাৎ প্রতিবেশীকে গরিব করে নিজেদের বড় হওয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তার ফলাফল হিসেবে দেখা গেছে, মহা মন্দা দীর্ঘায়িত হয়েছে। এখন যে বিশ্ব পরিস্থিতি, তাতে প্রতিবেশীকে গরিব করে কোনো রাষ্ট্রের এককভাবে ধনী এবং এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ট্রাম্প যেসব অর্থনৈতিক নীতির কথা বলেছেন, তার ৫০ শতাংশও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে আবার মহা মন্দা দেখা দিতে পারে। কিন্তু সেই অবস্থা এখন নেই। যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে চোখ রাঙানোর মতো আন্তর্জাতিক অনেক শক্তি তৈরি হয়ে গেছে। নিকট অতীতে যদি আমরা দেখি, ২০০৭-০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, সেটি যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র মিলে সম্মিলিতভাবে এই অবস্থা মোকাবিলা করেছে। সূত্র: প্রথম আলো।