আদালতের নির্দেশে ৮ কোটি ১০ ডলারের মধ্যে ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার ফেরত পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাকি অর্থ কবে পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ জন্য বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ।
প্রশ্ন: আমরা জেনেছি যে ফিলিপাইনের আদালত বাংলাদেশকে চুরি যাওয়া অর্থের একটি অংশ ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কবে নাগাদ এই ১ কোটি ৫২ লাখ ডলার ফেরত আসবে?
জন গোমেজ: গত ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ডলার হ্যাক করে সরিয়ে নেয় সাইবার অপরাধীরা। এই অর্থ যায় রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাকাতি শহরের জুপিটার স্ট্রিট শাখার চারটি হিসাবে। সেখান থেকে এই অর্থ চলে যায় বিভিন্ন জুয়া খেলার আসরে (ক্যাসিনো)। আমরা বলেছি, চুরি হওয়া ওই অর্থ আরসিবিসি থেকে ক্যাসিনো হয়ে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিপাইনের তদন্তকারীরা বলেছেন, আরসিবিসির পদ্ধতিগত ব্যর্থতার কারণে এমনটি ঘটেছে।
গত সপ্তাহে, সোমবার রিজার্ভের চুরি হওয়া অংশের দেড় কোটি মার্কিন ডলার (১২০ কোটি টাকা) বাংলাদেশকে ফেরত দিতে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত। ফিলিপাইনের ব্যবসায়ী কিম অং চুরির এ অর্থ জমা দিয়েছিলেন। এটি ফেরত পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফিলিপাইনের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছিল নগদ (ক্যাশ) নিতে। কিন্তু নগদ অর্থ বাংলাদেশে কীভাবে পাঠানো সম্ভব। পরে আলোচনার পর আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসি। কোনো একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা নিউইয়র্কের রিজার্ভে জমা করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে এখন ফিলিপাইনে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
প্রশ্ন: এটা তো চুরি যাওয়া অর্থের একটা অংশ। বাকি অর্থের ভবিষ্যৎ কী?
জন গোমেজ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশের চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে যে অংশ ফেরত পাওয়া যাবে না, তা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) কাছে দাবি করা যাবে। ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ চুরির পর ফিলিপাইনে অর্থ উদ্ধারের পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে বলতে পারি, চুরির পুরো টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আমি আশাবাদী। সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে আরসিবিসিতে যে পুরো অর্থ গিয়েছিল, তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। প্রমাণ ফিলিপাইন সরকারের কাছেও আছে। তাই এই অর্থ দাবি করা সম্ভব।
প্রশ্ন: চুরি যাওয়া বাকি অর্থ কোথায় আছে?
জন গোমেজ: চুরি যাওয়া অর্থের বড় অংশের হদিস আমাদের কাছে আছে। অনেক জায়গায় বলা হচ্ছে, কোনো হদিস নেই—এমনটি নয়। মামলা চলছে বেশ কিছু। এসব মামলার মাধ্যমে সময় লাগলেও চুরির পুরো অর্থ আমরা ফেরত পাব বলে আমি আশাবাদী। এর মধ্যে ২৫ থেকে ২৭ লাখ ডলার আগামী এক থেকে দুই মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে। এই অর্থ সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোতে বাজেয়াপ্ত করে রাখা আছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে শুক্রবার ফিলিপাইন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব আমরা। তারপরই সিদ্ধান্ত হবে ফেরত পেতে পরের পদক্ষেপ কী হবে।
প্রশ্ন: ফিলিপাইনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কি বাংলাদেশকে অর্থ ফেরত দিতে আগ্রহী?
জন গোমেজ: তদন্তের শুনানির একপর্যায়ে ব্যবসায়ী কিম অংয়ের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ ডলার ক্যাসিনো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন ফিলিপাইনের সুপ্রিম কোর্ট। তবে এই টাকা বাংলাদেশের নয় বলে আপিল করা হয় ফিলিপাইনের পক্ষ থেকে। আমরা বলেছি, কেন এই টাকা বাংলাদেশের হবে না। এই ব্যবসায়ী চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আমরা জোরালোভাবে বিশ্বাস করি, এই অর্থ রিজার্ভ চুরির অর্থ। আর এটা পেতে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া এখন আমাদের তৃতীয় পদক্ষেপ হবে। আমরা কিম অংয়ের বাজেয়াপ্ত এই অর্থ ফেরত পেতে কাজ করব। আমার ধারণা, এই অর্থের কিছু অংশ আমরা পাব।.
অর্থ উদ্ধারে সিনেটের যে শুনানি হয়, মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেম সার্ভিস করপোরেশনের কাছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার আছে বলে কিম অং যে দাবি করেছিলেন; তা অস্বীকার করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক বাতিস্তা দম্পতি। পরে চলতি বছরের এপ্রিলে ফিলরেমের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে মামলা করে ফিলিপাইনের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ সংস্থা (এএমসিএল)। এটাও আমরা দাবি করতে পারি।
প্রশ্ন: ফিলিপাইনে তো নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্টের মনোভাব কী?
জন গোমেজ: সবচেয়ে আশার দিক হচ্ছে, ফিলিপাইনের নতুন সরকার বাংলাদেশকে এই অর্থ ফেরত দিতে খুবই আগ্রহী। ফিলিপাইনের নির্বাচনের পর সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মাভেরিক রদ্রিগো দুতের্তে। তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের সহায়তা করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: ফিলিপাইনে সামগ্রিক প্রতিক্রিয়াটি কেমন?
জন গোমেজ: এই ঘটনাকে ফিলিপাইনে খুবই গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়েছে। ওদের ইতিহাসে এত বড় জরিমানার ঘটনা ঘটেনি। আপনারা জানেন, আরসিবিসি ব্যাংকে ১ বিলিয়ন পেসো জরিমানা করে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার এক কিস্তি ইতিমধ্যেই শোধ করেছে তারা। বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে আর কী করার আছে?
জন গোমেজ: আগামী মাসে বাংলাদেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বড় প্রতিনিধিদল ফিলিপাইনে আসবে। প্রতিনিধিদলে থাকবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও আইনসচিবও আসবেন। তাঁরা রিজার্ভ চুরির বাকি ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার ফেরতের বিষয়ে ফিলিপাইন নতুন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো।