মিজানুর রহমান, এফসিএস : বর্তমানে পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিতর্ক দেখা দিয়েছে। পুঁজিবাজারে চলমান নিম্নমুখিতার পেছনে এ বিতর্ক অনেকাংশেই ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে অনেকটা রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর সময়ে সময়ে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা, একক গ্রাহক ঋণসীমা ও বিনিয়োগ গণনা পদ্ধতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারীকৃত বিভিন্ন নির্দেশনার প্রভাব পড়েছে বাজারে।
গত বছর মে মাসে বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে চেয়ারম্যান করে নতুন কমিশন নিয়োগ করে সরকার। নতুন কমিশনের উদ্যোগে সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে চালু হয় পুঁজিবাজারের লেনদেন। ওই সময় লেনদেন চালু হলেও প্রাণ ছিল না পুঁজিবাজারে। ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমে গিয়েছিল দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ। গত বছরের জুলাই থেকে ছন্দ ফিরে পেতে শুরু করে পুঁজিবাজার। বিএসইসির সংস্কারমূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিতে নেয়া কিছু উদ্যোগের কারণে আস্থা ফিরে পেতে শুরু করে বিনিয়োগকারীরা।
২০১৮ সালে বিএসইসির সিজিসি কোড সংক্রান্ত দুই রেগুলেটরের মতের পার্থক্য নিয়ে কোন সমাধান এখনও হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে কোন ব্যাংক সিজিসি পুরো মানতে বাধ্য নন। ফলে সব তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠান এনআরসি পরিপালন করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তা মানছেনা। যার প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে।
ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজার বিনিয়োগ নিয়ে গত কয়েক মাস থেকেই বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পোর্টফোলিওর শেয়ারের দর বেড়ে বিনিয়োগের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে গেলে তা সমন্বয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
এছাড়াও পুঁজিবাজার বিশেষ তহবিলের অর্থ অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ এবং অদাবীকৃত লভ্যাংশের অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে স্থানান্তর করা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে।
পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রত্যেককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের সুযোগ রেখে গত ফেব্রুয়ারিতে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ও মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে চলতি বছরের মার্চে এক বৈঠকে বেশকিছু বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ প্রদানের সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করা, বিশেষ তহবিল গঠনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উৎসাহিত করা, বিশেষ তহবিলের অর্থ সুকুক, করপোরেট বন্ড, গ্রিন বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের ব্যবস্থা করা, ব্যাংকের ইস্যু করা পারপেচুয়াল বা বেমেয়াদি বন্ডকে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে দ্রুত লেনদেনের উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে ২ সংস্থার কর্মকর্তারা নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেন।
ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হয় এ বছরের সেপ্টেম্বরে। নির্ধারিত সীমার বেশি বিনিয়োগ করায় এ সময় বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংককে জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পুঁজিবাজার বিশেষ তহবিলের অর্থ অন্য শেয়ারে বিনিয়োগ করার কারণে আরো ১২ ব্যাংককে এ সময় সতর্ক করা হয়। এসব ব্যাংকের বিনিয়োগ চিত্রও খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ সীমার ওপরে চলে যাওয়া কিংবা কাছাকাছি অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোকে সমন্বয়ের জন্য মৌখিক নির্দেশনাও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলো তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ সীমা কিছুটা সমন্বয়ও করেছে, যার প্রভাবে সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে দরপতন হতে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের বিষয়টি বরাবরই স্পর্শকাতর। ফলে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের বেশ ভালো প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাজারে।
পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডে উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকের বিনিয়োগ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমা গণনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সে সময় কমিশনের কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও পুঁজিবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজার বিনিয়োগ সীমা গণনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে গণনা করার বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি অদাবীকৃত লভ্যাংশের অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে স্থানান্তর করা নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ব্যাংক হিসাবে থাকা অদাবীকৃত অর্থ অন্য কোথাও স্থানান্তরের সুযোগ নেই। অন্যদিকে বিএসইসির মত হচ্ছে, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিনিয়োগকারীর টাকা আর আমানতকারীর টাকা এক জিনিস নয়। দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ মতপার্থক্যের প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮টি ব্যাংক এ তহবিল গঠন করেছে। এর মধ্যে কেউই ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থও বিনিয়োগ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো তৎপর হলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ আরো বেশি হতো।
আবার কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে সে হল প্রাইমারী রেগুলেটর কারন ব্যাংকের ব্যাবসায়ীক লাইসেন্স দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে সকল ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ মানতে বাধ্য। আবার বিএসইসি বলছে তারা হলো সুপার রেগুলেটর কারন তারা ব্যাংকের মূলধনের যোগান দিচ্ছে আর মূলধন ছাড়া কেউ কখনও ব্যবসা করতে পারে না। সুতরাং মার্কেট থেকে কেপিটেল উত্তোলন করলেই তাদের বিএসইসির নির্দেশ মানতে হবে। সুতরাং ডিম আগে না মুরগি আগে সেই বিতর্কে পুঁজিবাজারে ছন্দপতন, নাকি; মানিনা মানবনা- মানতে হবে, মেনে নাও, সমস্যা আসলে কোনটা? আর এরজন্য দায়ী কে ?
লেখক : কলামিস্ট