বদরুল ইসলাম বাদল: প্রাকৃতিক দূর্যোগপ্রবণ বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেসে বিশ্বের বড়ো ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে দেশটি নাজুক ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। ফলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বেশির ভাগ নিম্নচাপই দেশে ঘূর্ণিঝড়,সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস আকারে আঘাত হানে, যা আমাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচে এঅঞ্চলের মানুষ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের উন্নয়নের সুফল প্রাকৃতিক দূর্যোগেই খেয়ে ফেলে অনেকটা। বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সমস্যা বর্তমান সময়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার বিরূপ প্রভাবের কারণে মানবজাতি শংকাজনক সময় পার করছে।ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে পরিবেশ। অসময়ে তীব্র দাবদাহ, অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি। নাতিশীতোষ্ণ ভূমণ্ডলীয় এ ভূখণ্ডের ষড়ঋতুর চক্রাকার নিয়ম এখন অনেকটা অনুভূত হয় না।
চেয়ে উতকৃষ্ট পদ্ধতি আর হতে পারে না। অক্সিজেন ছাড়া শুধু মানুষ নয় সৃষ্টির কোন প্রাণী বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আর এই অক্সিজেনের একমাত্র উত্স হলো বৃক্ষ। গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে বায়ুতে অক্সিজেন ছেড়ে দেয়। ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে না। তাই বলা যায় ধরণীতলে নিঃস্বার্থ ও প্রকৃত উপকারী বন্ধু হলো বৃক্ষ। বৃক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত। অথচ নগরায়ন ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য অযাচিত ভাবে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বন। হাদিস শরিফে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, “যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবে। (আবুদাউদ ৫২৪১)।
রাসুল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষরোপণ করে তার ফুলদার হওয়া নাগাদ তার দেখাশোনা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে,,তার প্রতিটি ফলের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে সদকা’র সওয়াব দেবেন। (মুসনাদে আহমদ ১৬৭০২)।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের দেশগুলোর সাথে একহয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, “পরিবেশ রক্ষা ও নিজের আর্থিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে সবদিক থেকে যেটা সবচেয়ে বেশি উপযোগী সেটা হলো ব্যাপক ভাবে বৃক্ষ রোপণ করা।শুধু গাছ লাগালে হবে না, গাছ যাতে টিকে থাকে সে জন্য যত্ন করতে হবে। সেই গাছ একদিন ফল দেবে, কাঠ দেবে বা ঔষধ দেবে”। গবেষণায় দেখা যায় যে, শারীরিক অসুস্থতা, মনের অস্থিরতা এবং খিটখিটে মেজাজ থেকে মুক্তি দিতে পারে সবুজ প্রকৃতি। কোন মানুষ যদি প্রকৃতির কোনো ছবির দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থাকে, তাহলে তার মেমোরি অনেকটা রিফ্রেশ হয়ে যায়। মানষিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। গাছ নিয়ে নিজের অনুভূতির প্রকাশ করতে গিয়ে আলোচিত কথা সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি উপলব্ধি এখানে তুলে ধরছি , “এই পুস্পিতার,এই বৃক্ষ, তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার মধ্যে কোন একাকীত্ব কোন বিচ্ছিনতা আমি অনুভব করতে পারিনে–” ব্যক্তির শুধু নয় গাছের প্রাণ মানে দেশের প্রাণ। দেশের অস্তিত্ব মানে প্রাণের অস্তিত্ব, প্রাণীর অস্তিত্ব। যে অঞ্চল যত গাছপালা, সেই অঞ্চল তত বেশী প্রাণবন্ত। গাছ ধৈর্যের প্রতীক, ধীরস্থির সাধনার প্রতীক, জীবনের সার্থকতার প্রতীক। শান্তি, সহিষ্ণুতা আর প্রশান্তির যে নিরব অভিব্যক্তি তা মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে। অঙ্গার বাতাসে মিশে থাকে, গাছ তা নিগূঢ় শক্তি বলে শোষণ করে নিজের করে নেয়”। ইদানীং বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে তাল গাছ লাগানোর উপর জোর দিচ্ছেন সচেতন মহল। তাই রাস্তার ধারে তালগাছ রোপণ করা জরুরি হয়ে গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধি করতে ফিলিপাইনে একটি মজার আইন পাশ হয়েছে। কোন ছাত্রছাত্রীকে প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজ পাশ করতে হলে ১০টি করে গাছ লাগানোর প্রমাণ দেখাতে হবে। শুধু গাছ লাগনো হলে হবে না পরিচর্যা করতে হবে। এভাবে একটি ছাত্রকে তিনবারে তিরিশটি করে গাছ লাগানোকে বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন কিছু আইন করা দরকার মনে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে ব্যাপকভাবে কার্যক্রমটা সকল স্কুল কলেজ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।জনমনে চেতনা সঞ্চার করার জন্য প্রচারণা চালাতে হবে। পাড়া-মহল্লায় মসজিদ গুলোতে জুমার নামাজের খুতবায় ইমাম সাহেব কোরান হাদিসের আলোকে বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারে।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র আওয়ামীলীগ জেলা সাধারণ সম্পাদক জননেতা মুজিবুর রহমান বলেন, “প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকিতে আমাদের কক্সবাজার জেলা। উপকূলে বেশি করে গাছের চারা রোপণ করে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী সৃষ্টি করতে পারলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ক্ষয় ক্ষতি থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যাবে”। তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে বৃক্ষ রোপণ করে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি উদ্বোধন করে ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেককে একটি করে ফলজ, বনজ এবং ঔষধি গাছ রোপণ করতে বারবার তাগিদ দিয়ে আসছেন। তাই বলা যেতে পারে, গাছের চারা রোপণ করা বঙ্গবন্ধু দর্শনের চর্চারই অংশ, যা প্রতিটি দলীয় কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতায় পড়ে”। নেতাকর্মীদের তিনটি করে গাছের চারা রোপণ করে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তব রুপ দিতে অনুরোধ করছেন সমুদ্র পাড়ের জনপ্রিয় জননেতা মেয়র মুজিব।সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় কোণাখালী ইউনিয়নের সভাপতি বদরুন নাহার কলি’র সাথে আলাপে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সমাজসেবামূলক কাজ করছেন, পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার ধারে গাছ রোপন এবং গাছ লাগানোর গুরুত্ব নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র মানুষের প্রিয়মুখ সমাজকর্মী কলি আপু বলেন, “মানুষ হিসেবে জন্মের দায়বদ্ধতা থেকে পরিবেশকে সুস্থ রাখতে সবাইকে গাছের চারা রোপণ দরকার”। বিশেষজ্ঞদের অভিমত,মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে আবহাওয়া উপযোগী গাছের চারা রোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে পরিবেশ বিধ্বংসী যেমন ইউক্লিপ্টাস,আকাশমণি সহ এধরণের গাছ রোপণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
দেশে এখন ও অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায়, বৃক্ষকে ভালবেসে গাছের চারা রোপণ করাকে পেশা এবং নেশা হিসেবে গ্রহন করেছেন। চকরিয়ার যুবক আদনান তামিম, “পিস ফাউন্ডার” নামে একটি স্বেচ্ছাজীবি সংগঠনের কর্ণধার তিনি। ২০১০ সালে সমমনা কয়েকজন তরুণ প্রজন্মের হাতে গড়ে উঠে এই সংগঠন। “আসুন সবুজে বাঁচি”শ্লোগানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাঝে বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করছেন এবং নিজেরা চারা রোপণ করছেন। আলীকদম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম জাফর আহমদের ছেলে রামিম। চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাথে বঙ্গবন্ধু দর্শনের নিবেদিত কর্মী তিনি। ইতিবাচক চেতনার সজ্জন আদনান তামিম সবুজ পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে নিজস্ব উদ্যোগে নার্সারি গড়ে তুলেছেন। শুধু মাত্র গাছের চারা বিতরণ করার জন্য। আদনান তামিম বলেন, “যারা স্বেচ্ছায় গাছ রোপণ করতে চান, বিনামূল্যে চারার প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। স্থান-পিস ফাউন্ডার নার্সারি (পিসল্যান্ড) কাকারা, বাদশারটেক, শাহওমরাবাদ মাজারের পূর্ব পাশে। তিনি আরও বলেন,’ প্রতিষ্টার পর থেকে প্রতিবছর গড়ে দুই হাজারের অধিক গাছ রোপণ এবং বিতরণ করে আসছি। প্রকৃতির জন্য একটা ই আমাদের উপহার”।
চকরিয়া সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় পর্বত সাবাড় অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে।
গবেষকদের মতামতে, “১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছ্বাসের পর বঙ্গোপসাগরের নিচের ভূ-স্তরে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে চট্টগ্রাম ও সিলেটে যেকোনো জায়গায় ভয়াবহ ভূমিকম্প হতে পারে বলে ভূতাত্ত্বিকরা আশংকা করছেন। কারণ সমুদ্র তীরের সাগরের প্রতিটি ঢেউ আছড়ে পড়ার সাথে সাথে যে কম্পনের সৃষ্টি হয় পার্শ্ববর্তী পাহাড় সে কম্পন নিয়ন্ত্রণে রাখে।পাহাড় কমে যাওয়ায় সে ভারসাম্য এখন হুমকির সম্মুখীন”। গবেষক রুজভেল্ট এর ভাষায়, “যে জাতি তার মাটি ধ্বংস করে সে নিজেকে ধ্বংস করে।বন হলো আমাদের জমির ফুসফুস, বাতাসকে বিশুদ্ধ করে এবং আমাদেরকে নতুন শক্তি দেয়”। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেকে ‘গাছ লাগাই সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলি’। সচেতনতায় ছড়িয়ে যাক সকলের মাঝে পিস ফাউন্ডারের সাথে, “নতুন চারার নতুন ভাষা, বৃক্ষ জাগায় বাঁচার আশা”।
লেখক: সদস্য বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।