“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ, কুসুম কুমারী দাশ- এর সেই ছেলে জন্মেছিলেন, যিনি বিশ্বকে জানিয়েছিলেন তাঁর গুণ- ‘আমি আমার দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি’… এমনকি সেই ছেলে তাঁর দূর্বলতার কথাও বলেছিলেন- ‘আমি আমার দেশ ও দেশের মানুষকে অধিক ভালোবাসি’।
যদিও সেদিন শেষের লাইনটাকে কেউই দূর্বলতা মানতে রাজি হয়নি, তবুও ঐ দূর্বলতার কারণেই, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী- ইতিহাসের কিংবদন্তী; যাকে অনুসরণ করে এদেশে জন্মেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা।
১৯৭২ এর ১০ই জানুয়ারি, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ১১ই জানুয়ারিতে প্রথম জাতীয় সরকার ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্র প্রবর্তন; সেদিন যদি কিছুটা সময়ের জন্যে- রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের কাঠিন্যে দৃঢ় হতেন তবে ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭৫, পুনরায় ‘বাকশাল’ গঠন যেমন প্রয়োজন হতো না তেমনি হয়তো দেশের ইতিহাসে ১৫ই আগস্টের মতো কলঙ্কিত অধ্যায় যুক্ত হতো না!
১৯৪৭ এর পর ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ’৭১ এর স্বাধীনতা তথা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ দাবিতে প্রতিষ্ঠিত ৯০ পরবর্তী আজকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।
বাঙালির অধিকার আদায় ও হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন টুঙ্গীপাড়ার সেই ছেলে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়—হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান। পাকিস্তান দুটি পৃথক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় যার একটি পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বাঙালিদের উপর শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি বাঙালিদের আবারও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। বাঙালিদের শোষণ-বঞ্চনা ও নীপিড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম শুরু হয়। যার সূচনা আমরা দেখতে পাই ভাষা আন্দোলনেই। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার পরেই বাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ভাষা আন্দোলন সংঘটনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে সোচ্চার হন, ভাষা আন্দোলনের জন্য তাকে বার বার কারারুদ্ধও হতে হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি জেলে বসেই বিভিন্ন ভাবে ছাত্রনেতাদের দিক নির্দেশনা দেন। বায়ান্ন থেকে একাত্তর শোষিত বাংলার মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করতে দিনের পর দিন তিনি নিজে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৫৪ বছরের জীবনের মধ্যে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ৬৮২ দিন (প্রায় ১৪টি বছর ও মোট ১৮ বার) কারাভোগ করেছেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুবার (তথ্য সূত্র: আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের সংসদে দেওয়া বক্তব্য)।
একটা জাতির স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী আন্দোলন সংগ্রাম করার পরও স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না শুধুমাত্র একজন যোগ্য, দূরদর্শী এবং অকুতোভয় আপসহীন নেতার অভাবে। সেদিক থেকে আমরা বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান, আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো মহান নেতা। হয়ত এ মহানায়কের জন্মই হয়েছিল বাঙালি জাতির হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষা— বিশ্বের মানচিত্রে খচিত বাংলার স্বাধীন মানচিত্র, একটি স্বাধীন পতাকা ও স্বাধীনতা উপহার দেওয়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম আন্দোলনের পর, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ৩০ লাখ শহিদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য গুদাম, শিল্প কারখানা, স্কুল, কলেজ পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থী ফিরিয়ে আনা, শহিদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা, সেই সঙ্গে ১৯৭২ সালের ভয়াবহ খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিসমূহের নানাবিধ ষড়যন্ত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন বঙ্গবন্ধু।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই ৪ নীতির ভিত্তিতে যে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা ঝাপিয়ে পড়েছিল, সেই চার নীতির ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশি-বিদেশি নানা বাধা বিপত্তি, ষড়যন্ত্র ও সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাত্র ৩ বছরে (১৯৭২-৭৫), যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল, তা এককথায় বিস্ময়কর। চিরকাল নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মাত্র ৩ বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সার্বিক, টেকসই উন্নয়ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র গঠনের জন্য অনেক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক সুখী সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিল তার শক্ত ভিত তিনি নিজেই সেই সময়ই স্থাপন করেন।
বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার থামিয়ে দিতে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র হয়। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়, রচিত করে বিশ্বাসঘাতকতার কালো ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত ঘাতকচক্র ও নব্য অম্ভি থেকে মীরজাফররা বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।
হয়ত ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল অবদান ও ইতিহাস বাঙালিদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তারা জানত বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে থাকলে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না তাই পরিবার সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ঘাতকরা।
জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে-বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছেন- জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে কি হয়নি তা সময়ই নির্দিষ্ট করবে?