প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী: প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তখন তা মোট জাতীয় উৎপাদনশীলতায় সংযুক্তি ঘটে। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় যখন সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি কাজ করে, তখন এটি মানুষের অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে হতদরিদ্র এবং দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের কারণেই বর্তমান সরকার আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা- পরিচালনা করছে, যার মাধ্যমে মানুষ সঞ্চয় বিনিয়োগে উৎসাহী হয় এবং ভোগ প্রবণতায় তার দক্ষতা ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে থাকে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন যে, ক্ষুদ্র সঞ্চয় হতে হবে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ।
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য বিশেষত দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য বর্তমান একবিংশ শতকের দ্বিতীয় যুগে সামাজিক যোগাযোগ যথেষ্ট মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি অলিখিতভাবে হাজার বছর ধরে কেবল বাংলাদেশ নয়, দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্রে যারা দেশে দেশে, কালে কালে যুক্ত রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বটি বহুল প্রচলিত একটি ব্যাপার। সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতায়ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই ঘটে থাকে। এলজিআরডি মন্ত্রণালয় ৪০.৫২৭ গ্রামে কাজ করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য করার অনুমতি দেয় না। বরং তাদের অধিকার নিশ্চিত করে এবং তাদের মুক্তির জন্য সুযোগ প্রদান করে। ‘নারীদের তাদের নিজেদের ভবিষ্যত তৈরি করতে হবে। আত্মনির্ভরশীলতায় তাদের আত্মবিশ্বাস দিতে হবে।’
পরিবর্তিত বিশ্বের কারণে প্রাচীনকাল থেকে অলিখিতভাবে চলে আসা সামাজিক গণমাধ্যম-ইন্টারনেট-মোবাইল সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে আর্থিক পরিবেশ জানার জন্য ইন্টারনেট-মোবাইল ব্যবস্থাপনা অতি দ্রুত কাজ করে থাকে। বাংলাদেশের একটি গ্রামের কথাই ধরা যাক, যেখানে আগে যোগাযোগে অনেক বিলম্ব হতো। এখন মুহূর্তের মধ্যে মোবাইল বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যায়। গ্রামীণ একজন কৃষক মোবাইলের কল্যাণে শহরে ফোন করে জানতে পারে, কি দরে তার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
অবশ্য সরবরাহজনিত ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মাঝখান থেকে লাভ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারপরও ৩০-৪০ বছর আগে কৃষক, মৎস্যজীবীসহ অন্যান্য পেশার লোকদের আগের মতো ঠকানো সম্ভব হচ্ছে না। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই বণ্টন ব্যবস্থাকে সুষম ও জনমুখী করার প্রয়োজন রয়েছে। নচেত এ ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত হবে, প্রকারান্তরে তা বাজার ব্যবস্থাপনার সকল ত্রুটিবিচ্যুতিকে দূর করবে না। বরং তথ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বহাল থাকবে। এজন্য অবশ্য সরকার মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর প্রয়াস গ্রহণ করেছে এবং সরাসরি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে গ্রামীণ অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে, তত নানামুখী পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদানসমূহ। এক্ষেত্রে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা কাজ করে থাকে।
লেইক এবং হাকফেলট মন্তব্য করেছেন যে, সামাজিক পুঁজি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, যা নাগরিকদের মধ্যে একটি সম্পর্ক উন্নয়ন করে, সামাজিক পুঁজি বৃদ্ধি করে এবং কৌশল হিসেবে রাজনৈতিক উপায় ও প্রক্রিয়াকে অনেকাংশে সাফল্য দিতে সক্ষম হয়। যেহেতু জননেত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে পেট-ভাতে রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী, সেহেতু সামাজিক উন্নয়ন, জীবন দর্শন, মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, নীতিজ্ঞান এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়াসের ক্ষেত্রে ব্যস্টিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সুসংহত করার মাধ্যমে। সুদের বিশাল বোঝা ফেলে ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য মোকাবেলার জন্য একটি সমাধান হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী আত্মকর্মসংস্থানের ওপর ভিত্তি করে দারিদ্র্য বিমোচনে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণার কথা স্মরণ করে বলেন যে, ‘একটি পরিবার, একটি খামার’ এবং আশ্রয়ণ বর্তমান সরকারের স্কিম।
রাজনৈতিক দর্শনই বর্তমানে সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠতে সহায়তা প্রদান করছে, যা মানুষকে বহুমুখী দরিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হচ্ছে। পরিবেশ অবশ্যই সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তা বস্তুত সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের পাশাপাশি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আট ধাপ অবস্থান উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। কমিউনিটি ব্যাংকিং তৃণমূল পর্যায়ে করা গেলে তা আরও গতিময়তা পাবে।
সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় সামাজিক বুদ্ধিমত্তা। রিগো (২০১৪) মন্তব্য করেছেন, সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণ চলার মতো গুণ এবং সমাজের অন্যদের সঙ্গে একীভূতভাবে কর্মসম্পাদন করার ক্ষমতা বোঝায়। রিগোর এ বক্তব্য তাৎপর্যম-িত। আমরা যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব যে, অগ্রসরমান জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সামাজিক বুদ্ধিমত্তা একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আসলে যূথবদ্ধভাবে সমাজে বাস করতে গেলে সামাজিক বুদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন হয়, যা সমাজের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে থাকে।
লিডবিরটর ১৯৯৭ সালে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সামাজিক উদ্যোক্তা উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। তার এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। যখন কোন উদ্ভাবন ঘটে থাকে তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এ উদ্ভাবনী শক্তিকে মানুষ যদি তার ও সমাজের উন্নয়ন কর্মকা-ে পরিচালিত করে, তবে তা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আবার খারাপ কাজে ব্যবহার করলে তা কিন্তু হিত সাধনের বিপরীত ভিন্নমুখিতা দেয়।
আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি, পারমাণবিক বোমা উদ্ভাবনের পর নাগাসাকি ও হিরোশিমায় তা মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আবার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের মাধ্যমে জনকল্যাণেও ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে সামাজিক উদ্যোক্তারা সমাজে দক্ষতা, কার্যকারিতার মাধ্যমে যোগ্য মূল্য সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়ে থাকে।
এ দেশে আবহমানকাল থেকে সামাজিক ব্যবসা প্রচলিত ছিল, যার মূল ভিত্তি ভূমি ছিল সামাজিক পুঁজি, বিনিয়োগ ও শ্রম। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম দিকে এটি নিজের উদ্ভাবন বলে দাবি করলেও এক্ষণে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বলেছেন এটির ব্র্যান্ড এ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মনে পড়ে ২০১৩ সালে যখন তৃতীয়মাত্রায় বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম, তখন এদেশের একজন অর্থনীতিবিদ বিষয়টির প্রচ- বিরোধিতা করেছিলেন।
শেখ হাসিনা বর্তমানে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন। এটি সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে সামাজিক পুঁজিতে রূপান্তর ও পাশাপাশি মানব পুঁজি এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন, কর্মদক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রদর্শন করা সম্ভব হয়। উদ্যোক্তাকে অবশ্যই সামাজিক উন্নয়নে জনগণের প্রয়োজনের নিরিখে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় ক্ষমতায়ন, ক্রয়ক্ষমতা এবং সামাজিক উদ্যোক্তা একত্রিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনাকে একটি দেশের উন্নয়নে কাজ করে অতি দরিদ্র কিংবা দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র থেকে মুক্তি দেয়। এক্ষেত্রে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অথবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এতে দেখা যায় যে, পরিবেশও বেশ গুরুত্ব বহন করে থাকে। উপরোক্ত মডেলটি দেশে, বিদেশে বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। টাকার অভাবে কেবল খুলনায় দুটো গ্রামে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ তত্ত্ব জনগণের ক্ষমতায়নে কাজ করে থাকে। এটি ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী খাত এবং বিদেশী গবেষকদের কাছে অনুরোধ জানাই। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে মানব উন্নয়ন ও আত্মমর্যাদাশীল করে তুলতে হলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের জন্য তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাসংক্রান্ত বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, আইটি ও উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ। সাবেক উপাচার্য প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।