বদরুল ইসলাম বাদল : করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে নতুন প্রাণের স্পন্দন। কবির ভাষায়,” জাগিল কি ছন্দ, আজি এ বসন্ত আকাশে।” নিথর পৃথিবী কোমা থেকে জেগে ফিরে আসছে নতুন ছন্দ, তাল,তান, গান, সুর নিয়ে। দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা নিয়ে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন শেষ হল। মহামারীতে টানা দুই তিন বছর এই আয়োজন বন্ধ ছিল। সাধারণত জানুয়ারী ফেব্রুয়ারিতে এসব প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চায় গুরুত্ব প্রদানের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “শারীরিক -মানসিক বিকাশে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিকল্প নেই”। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থ বলেছিলেন,” আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়।যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। “
শিক্ষাবিদের মতে “শিক্ষা একটি জাতির অবয়ব নির্মাণ করে, সাহিত্যে সে অবয়বের প্রতিফলন ঘটে। আর সংস্কৃতি তাকে পূর্ণতা দান করে। এভাবেই একটি জাতির পরিচয় বিধৃত হয় তার শিক্ষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে”। অন্যভাবে, “একটি দেশ এবং জাতির অগ্রগতির মুল চালিকা শক্তি হল শিক্ষা”। আবার তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামোতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দরকার যুগোপযোগী শিক্ষা। তাই পড়ুয়াদের জাগরিত করতে হবে সৃজনশীল প্রতিভার। প্রাথমিক স্তরে এই কাজটির হাতেখড়ি হয় বিদ্যালয়ে। এটাই পড়ুয়াদের অবচেতন মনন বিকাশের আতুরঘর। যার ধারাবাহিক সৃজনশীল জ্ঞানের প্রবাহ নিজের এবং জাতির অগ্রগতি অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন প্রতিক্ষেত্রে বিকশিত মেধা চর্চার পরিবেশ তৈরীর ভূমিকা বিদ্যালয়কেই দেখতে হয়। বলা হয়ে থাকে যে “বিদ্যালয় সমাজ, রাষ্ট্র এবং জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য শুধু লালনই করে না, সংরক্ষণ ও পরিচর্যায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে”। প্রমাণিত সত্য যে, প্রতিটি জাতির উন্নতির ভিত্তি নির্ভর করে সে জাতির শিক্ষার উপর”। বহুল প্রচলিত প্রবাদ “যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত”। তবে কথাটি সুপ্রচলিত সত্যি হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে “সুশিক্ষা” র উপরই শিক্ষাবিদগন জোর অভিমত ব্যক্ত করছেন। সার্টিফিকেট কিংবা জিপিএ মেধা নির্ধারণের মাপকাঠি নয়। এখন সর্ব ক্ষেত্রে ভাল রেজাল্ট নিয়ে হইচই। আর ভাল রেজাল্ট মানে জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোচিং সেন্টারের নোট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় হুবহু লিখে নাম্বার নিয়ে পাশ করাকেই মনে করে অতিউৎসাহী অভিভাবকমহল। বিশ্লেষকগণ এই রকম ভাল রেজাল্টকে কোচিং সেন্টারেরই পাশ মনে করেন।কারণ নোট তৈরির কাজটি করে থাকে কোচিং সেন্টার। শিক্ষাথীরা মুখস্ত করে উত্তর পত্রে হুবহু লিখে আসে। এই পর্যায়ে নব্বই দশকের আমার একজন সন্মানিত শিক্ষকের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তিনি এডভোকেট শাহআলম। চকরিয়া উপজেলা আদালতের সিনিয়র আইনজীবী। তিনি আইনজীবি পেশায় আসার আগে চকরিয়া উপজেলাধীন ইলিশিয়া জমিলা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তিনি নবম দশম শ্রেণির বাংলা ক্লাস নিতেন।
নোট তৈরী নিয়ে তিনি বলতেন যে, ” আমি নোট তৈরীতে বিশ্বাসী নই।প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের নিজের মত করে নোট তৈরীর পারদর্শী করে গড়ে তুলতে চাই। আমি চাই আমার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নোট তৈরী করার জন্য নিজেদের মধ্যে সক্ষমতা আসুক”। তিনি আরও বলতেন, “নোট লিখে পরীক্ষা দেয়া হলে স্কুলের প্রতিটি ছাত্রের উত্তরপত্র একই রকম হবে। তখন পাবলিক পরীক্ষার পরীক্ষকগণ খাতা মুল্যায়ন করার সময় বিষয়টি অনায়াসে বুঝতে পারবে”। তাই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এডভোকেট শাহ আলম নোটথেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। জানি না আজকাল পরীক্ষকদের খাতা মুল্যায়নের মাপকাঠি। কারণ দেখা যায়, সারা বছর কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের ভীড়। ভাল রেজাল্টও করছে অহরহ। জিপিএ ফাইভের ছড়াছড়ি। আবার জিপিএ ফাইভ না পেলে অভিভাবকগণ মনে করে যে তাদের সন্তান প্রতিভাবান নয়।সন্তানদের শুনতে হয় বকাঝকা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে তা আধো টিক নয়।দেশে কিংবা বিদেশে অনেক ছাত্র ফাস্ট /সেকেন্ড না হয়েও অনেক সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বলা হয়ে থাকে যে, “মেধা একজন মানুষের বিশেষ কিছু গুণ ও দক্ষতা, অপর দিকে প্রতিভা হল একজন মানুষের সৃষ্টিশীল মানষিকতা এবং অনেক দুরূহ কাজে হাত দেওয়া এবং আবিষ্কার করা”। তাই মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে শিক্ষকদের ভূমিকাই অগ্রগণ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,” সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে সমাজ এগিয়ে যাবে”। এক অনুষ্ঠানে তিনি খাদ্যে স্বনির্ভরতার জন্য কৃষিক্ষেত্রের গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণার উন্নতি না হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।শিক্ষাকে বাস্তব জীবনমুখী ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে গবেষণার বিকল্প নেই। মুখস্ত বিদ্যায় অর্জিত সার্টিফিকেট নিয়ে দেশের কোন কাজে আসবে না। উল্লেখ্য যে, ইলিশিয়া জমিলা বেগম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে মেধাবী শিক্ষকমণ্ডলী দিয়ে পাঠদান করে আসছে। এই স্কুলের সুনামের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক, কৃতজ্ঞতার সহিত কামনা করি ।
বর্তমানে যেকোনো জায়গায় দিন দিন আনুষ্ঠানিকতা বাড়ছে। লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে চেতনা। জাতীয় দিবস কিংবা যে কোন সভায় তথ্যনির্ভর আলোচনা হয় না। দায়সারা ভাবে মাইকের সামনে দাঁড়াতে পারলেই হল, সফল অনুষ্ঠান। বক্তার সংখ্যা এত বেশি হয় যে, স্বল্প সময়ে কোন আলোচকই মর্মার্থ বিশ্লেষণের সময় পায় না।ব ক্তাকে শুরুতেই কথা সংক্ষিপ্ত করার পরামর্শের ফলে, বক্তব্যে মুল বিষয় তুলে ধরার আগেই সময় শেষ হয়ে যায়। বক্তার সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রধান অতিথি বা আলোচক বক্তব্য রাখার সময় পায় কম। এই নিয়ে অনেক রাজনৈতিক সংগঠনের মিটিংএ প্রধান অতিথি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা যায়। সমালোচকমহল ইদানীং এই বিষয়টিকে ফটোসেশান বক্তৃতার সভা বলা শুরু করেছে।শুধু তাই নয়, অনেক জায়গায় অতিথিদের ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ার উদাহরণও অনেক। তাই সচেতন মহলের অভিমত, এসবের গুনগত পরিবর্তন না আসলে প্রজন্মের কাছে ইতিহাস চর্চা নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।স্কুল কলেজে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন হয়। এসব অনুষ্ঠানে গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কারণ, বিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের আলোকিত জীবন গড়ার বাতিঘর। শিশুদের মধ্যে সততা নৈতিকতাসহ ইত্যাদির বিকাশ নিয়ে নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে বিদ্যালয়। কক্সবাজার পৌর প্রিপারেটরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন,” বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি কিংবা প্রধান আলোচক হিসেবে একজন আলোকিত শিক্ষাবিদ কিংবা সৃষ্টিশীল কাজে সফল ব্যক্তিত্বকে আমন্ত্রণ করা দরকার। যিনি নিজের সফলতার গল্প শুনাবে, শিক্ষার্থীদের উত্সাহিত করবে”। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্টদের মতে দেশবরেণ্য আলোকিত ব্যক্তিত্বদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ শিক্ষার্থীর জন্য একটা অনুপ্রাণিত স্মরণীয় স্মৃতি আজীবন।উচ্চতর শিক্ষাঙ্গন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় যে, সমাবর্তন অনুষ্ঠান বা যেকোনো অনুষ্ঠানে সবসময় একজন বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান ব্যক্তি আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। তিনি দেশের কিংবা বাইরের ও হতে পারেন। যার মোটিভেশনাল বক্তৃতা উজ্জীবিত করবে শিক্ষার্থীদের মনন জগৎ। তাই একজন জ্ঞানতাপস প্রধান অতিথি বা আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত করা হলে অনুষ্ঠান আরও অর্থবহ হবে মনে করে শিক্ষার সাথে যুক্তমহল। .
অভিনন্দন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামের নব নির্বাচিত সচিব,অধ্যাপক রেজাউল করিম। চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি এবং চকরিয়ারই কৃতি সন্তান। চকরিয়া কেন্দ্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় কতৃপক্ষ অধ্যাপক রেজাউল করিমের সন্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। একজন প্রতিভাবান মানুষকে কাছে পেয়ে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দে মেতে উঠে। স্কুলের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন শিক্ষার্থীদের অভিমত,কক্সবাজারের অনেক প্রতিভাবান মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দক্ষতার সাথে নিজেদের প্রতিভার সাক্ষর রেখে যাচ্ছেন।তাদের পরিচয় তুলে ধরা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা তাদের সান্নিধ্যে উত্সাহিত হবে, অনুপ্রাণিত হবে।
লেখক: বদরুল ইসলাম বাদল, সমাজকর্মী ও সাবেক ছাত্রনেতা।