দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৫ সালে চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার (সিসিও) নিয়োগ দেয় বাংলালিংক। এ পদে নিয়োগ পান দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সচিব ও ইন্টারনাল অডিট অ্যান্ড ইন্টারনাল কন্ট্রোল বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকা এম নুরুল আলম। কমপ্লায়েন্স বিষয়ে তিনি ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফায়েড কমপ্লায়েন্স অ্যান্ড এথিকস প্রফেশনাল (সিসিইপি-ওয়ান) ডিগ্রিধারী। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রাতিষ্ঠানিক কমপ্লায়েন্স ও এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানিয়েছেন তিনি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টেলিকম খাতের কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত বিষয়গুলো কী কী?
এম নুরুল আলম: কমপ্লায়েন্সের মূল উদ্দেশ্য হলো, সব ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা। যেহেতু বিনিয়োগ ও সেবার ব্যাপকতার বিবেচনায় টেলিকম বড় একটি খাত, তাই এ খাতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করতে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষ সঠিকভাবে নিয়ম-নীতি অনুসরণ করছে কিনা, তা প্রতিনিয়ত নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। নিয়ম-নীতি বলতে এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আচরণবিধি অনুসরণ, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুর্নীতিবিরোধী নীতিমালা প্রতিপালন নিশ্চিত করা।
প্রশ্ন: কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন?
এম নুরুল আলম: প্রত্যেক বহুজাতিক বা বড় পরিসরের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আচরণবিধি থাকা একান্ত প্রয়োজন। কোনোভাবে এ আচরণবিধির লঙ্ঘন ঘটছে কিনা, তা নির্ণয় করা কমপ্লায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে অবৈধ অর্থের লেনদেন থেকে মুক্ত রাখার বিষয়টিকেও কমপ্লায়েন্সে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বের উদ্ভব ঘটছে কিনা, সেটির তদারকিও কমপ্লায়েন্সের মূল কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে। এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হলে একটি প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স অনেকাংশে নিশ্চিত করা সম্ভব।
প্রশ্ন: সামগ্রিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কমপ্লায়েন্স বিষয়টিতে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান কেমন?
এম নুরুল আলম: বর্তমানে দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানই কমপ্লায়েন্সকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এটি অবশ্যই অত্যন্ত ইতিবাচক একটি বিষয়। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে কমপ্লায়েন্সের ভিত্তিকে মজবুত করতে হলে আরো বেশিসংখ্যক দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে— ব্যবসায়িক কার্যক্রম যত সম্প্রসারিত হয়, কমপ্লায়েন্সের প্রয়োজনীয়তা ততই বৃদ্ধি পায়। একজন অভিজ্ঞ কমপ্লায়েন্স বিশেষজ্ঞ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নির্ধারণেও সহায়তা করতে পারেন।
প্রশ্ন: প্রাতিষ্ঠানিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
এম নুরুল আলম: প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নীতি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানা না থাকলে কর্মীরা নিজের অজান্তেই অনেক ক্ষেত্রে নীতিবহির্ভূত কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক। একজন ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের (মূলধন) উল্লেখযোগ্য অংশীদারিত্ব গ্রহণ করতে পারবেন না। আবার একজন ব্যক্তিকে দিয়ে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে কোনো উপহার প্রদান করা হলে তা গুরুতর অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ধরনের আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতন থাকা জরুরি। বাংলালিংকে প্রত্যেকে যাতে প্রতিটি নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অবগত থাকে, সেজন্য আমরা প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এছাড়া বাংলালিংকের কর্মীরা গিফট অ্যান্ড হসপিটালিটি পলিসি মেনে চলেন।
প্রশ্ন: দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় কমপ্লায়েন্স বিষয়টি দেখার জন্য এখন পর্যন্ত আলাদাভাবে সিএক্সও পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ হয়নি। বাংলালিংক এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এর কারণ কী?
এম নুরুল আলম: বাংলালিংকের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ভিওন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কমপ্লায়েন্স চর্চার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। এজন্য বাংলালিংকের কার্যক্রমের প্রতিটি স্তরে সততা ও জবাবদিহিতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে বাংলালিংকে চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে, যারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করে। বাংলালিংকের মতো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, ব্যবসায়িক অংশীদার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কার্যকলাপে সততা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সিএক্সও পর্যায়ে অভিজ্ঞ কমপ্লায়েন্স বিশেষজ্ঞের দিকনির্দেশনা একান্ত প্রয়োজন। কারণ কমপ্লায়েন্স কোম্পানিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: দৈনন্দিন কার্যক্রমে কমপ্লায়েন্সের বিষয়টিতে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?
এম নুরুল আলম: দৈনন্দিন কার্যক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আমরা সাধারণ আচরণবিধি, বিজনেস পার্টনার কোড অব কন্ডাক্ট, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট পলিসি, সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট পলিসি ও অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কাউন্টার টেরোরিস্ট ফিন্যান্সিং পলিসির মতো বিষয়গুলোকে মেনে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে বিষয়টি সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকি। এছাড়া কমপ্লায়েন্স সপ্তাহ উদযাপন ও কর্মীদের কমপ্লায়েন্স-সংক্রান্ত বার্তা প্রদানও আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ।
প্রশ্ন: বাংলালিংকে কর্মীদের কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত কী ধরনের বাধ্যবাধকতা দেয়া হয়? কমপ্লায়েন্সের বিষয়টি তদারকির ক্ষেত্রে শীর্ষ ব্যবস্থাপনার কোনো প্রভাব রয়েছে কি?
এম নুরুল আলম: প্রথম দিন থেকেই আচরণবিধি মেনে চলতে হয় বাংলালিংকের প্রত্যেক কর্মীর। চাকরিতে যোগ দেয়ার সময়ই এতে সই করতে হয় তাদের। পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার মূলত স্বাধীনভাবে কাজ করেন। সরাসরি ভিওনের কাছে জবাবদিহি করতে হয় তাকে। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় যাতে কোনো ধরনের প্রভাব কাজ না করে, সেজন্যই এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
প্রশ্ন: কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ভবিষ্যতে বাংলালিংকের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি?
এম নুরুল আলম: প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্য প্রতিনিয়ত বাংলালিংকের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চলছে। প্রাতিষ্ঠানিক কমপ্লায়েন্স চর্চার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে ভবিষ্যতে আমরা আরো নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে চাই।
সৌজন্যে: বণিক বার্তা