সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জ বার বার রাক্ষসী যমুনার ভাঙনে এখন ক্লান্ত অসহায় হয়ে পড়েছে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার মানুষ। গত এক যুগে একাধিকবার ভাঙনে পিছনে সরে আসতে আসতে আর তাদের যাবার কোন জায়গা নেই, ঘরবাড়ি নেই। নদীগর্ভে সব হারিয়ে তারা এখন ভূমিহীন দরিদ্র হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ এ উপজেলা থেকে চলে গেছে। বছরের পর বছর ধরে উপজেলার মানুষ ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী বাধ নির্মাণের কথা শুনে আসলে তা আজও আলোর মুখ দেখেনি।
চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরবিনানুই গ্রামের দুই বিধবা বোন বেদানা ও রিনা খাতুন। বিয়ের পর তাদের সংসার ভালই কাটছিল। ঘর আলো করে তাদের সংসারে আসে ছেলে মেয়ে, স্বামী মাঠে ঘাটে দিন মজুরি করে নিজেদের ভিটেই ভালই কাটছিল তাদের সংসার। দুই যুগ আগে হঠাৎ ক্ষেপে ওঠে যমুনা। শুরু হয় তীব্র ভাঙন। হারিয়ে যায় তাদের বসতভিটা, জমিজমা। পিছনে সরে এসে তারা আবার ঘরবাঁধে। সেটাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
এভাবে কয়েকবার যমুনায় তাদের ঘরবাড়ি জমিজমা হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। যমুনার সাথে যুদ্ধ করে ঘরবাড়ি টিকিয়ে রাখা আর সংসার করতে গিয়ে তাদের স্বামী গত হয়েছে অনেক আগেই। স্বামীহারা দুই বোন আশ্রয় নেয় বাবার দেয়া যমুনা পাড়ের ৬ শতাংশ বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের কোনমতে বড় করেছেন। জীবনের শেষবেলায় একটু সুখের আশা করলেও দুই বোনের সেই স্বপ্ন সুখের বসতঘরে আবারও হানা দিয়েছে সর্বনাশা যমুনা নদী। তার করাল গ্রাসে ইতোমধ্যে বাবার ৬ শতাংশ বসতবাড়ির অর্ধেকের বেশি চলে গেছে, এখন ঘরের দরজার সামনে এসে ঠেকেছে ভাঙন।,
পিছনে সরে যাবার কোন জায়গা নেই। উপায় না থাকায় সেখানেই ঝুঁপড়ি তুলে বসবাস করছে তারা। তাদের ছেলে মেয়েরা কাজের সন্ধানে বাইরে থাকে। সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, ছোটবোন রিনা খাতুন ভাঙনের মুখে চুলায় বসে রান্না করছেন। বড়বোন বেদানা খাতুন মাছ কাটছেন।,
সামনেই পড়ে আছে কয়েকটি ভাঙা মাটির কলস। ঘরে তেমন কিছুই নেই। এমন ভাঙনের মুখে ঝুঁকি নিয়ে কেন আছেন জানতে চাইলে তারা জানান, এই সামান্য বাড়ি ছাড়া তাদের কিছুই নেই। এইটুকো যতদিন আছে তারা মা বাবার স্মৃতি মনে করে এখানেই থাকতে চান। এটা শেষ হয়ে গেলে টাঙ্গাইল জেলায় সরকারি খাস জায়গায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।,
এ কথা বলতেই বেদানা খাতুনে চোখ ভিজে যায়। কেঁদে ওঠেন তিনি। জানান, এই মাটিতেই তার জন্ম। এই মাটিতেই মা-বাবা, স্বামী স্বজনদের কবর। নদীতে সব হারিয়ে এখন খালি হাতে চলে যেতে হচ্ছে তাদের, যে কোন সময় তার পায়ের তলার শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে যাবে। এ কথা বলে তিনি নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। পাশে অশ্রুসজল ছোটবোনও। বাকরুদ্ধ তারা,।
তাদের মতো এমন ঘরবাড়ি হারানো অসংখ্য মানুষের বসবাস চরবিনানুই গ্রামজুড়ে।
পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, যমুনা নদী তাদের প্রবল বেগে আঘাত হেনেছে চারদিক থেকে। যতদুর চোখ যায় যমুনার ভাঙন চোখে পড়ে। নদীর একেবারে ভাঙনের মুখেই ঝুঁপড়ি ঘর তুলে অসংখ্যা মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস। সবার ঘরবাড়ি ভাঙা। আঙিনার সামনে পড়ে আছে ভাঙা ঘরের চালা, কাঠসহ জিনিসপত্র। প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় গেলেই ভাঙা ঘরবাড়ি দেখে বোঝা যায়। ঘরবাড়ি জমিজমা হারানো এই মানুষগুলোর এখন দিনচলে যমুনায় মাছ ধরা আর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দিন মজুরি করে। কারো হাতে সঞ্চয় নেই’। ঘরে খাদ্যর মজুত নেই। এভাবে কষ্টে চলছে তাদের দিন।
রবিনানুই গ্রামের আব্দুল মতিন (৬২) জানান, ২ বার তার ঘরবাড়ি ভেঙেছে। যমুনায় জমি জমা সব হারিয়ে তিনি এখন ভূমিহীন। নদীর ধারে ঝুঁপড়ি তুলে বসবাস করছেন। মাছ ধরে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে কোন মতে সংসার চালাচ্ছেন। সামনে ঝর বৃষ্টি বাদলের দিন আসতেছে। এই ঘর থাকবে কিনা সেই চিন্তায় তিনি হতাশ।একই গ্রামের আব্দুল বারেক (৬৯), জানান, আমার বাপের ৪০ বিঘা বাড়ি জমি পাইছিলাম। কয়েকবার যমুনার ভাঙতি ভাঙতি এহুন আর কিছুই নাই। হারাদিন কাম কইরা যা পাই তাই দিয়া হংসার চালাই। ছাওয়াল-পাওয়ালেক আমার বাপের কোন সম্পত্তি দিবার পারলাম না।’
চৌহালীর বিভিন্ন এলাকায় জমি জমা ঘরবাড়ি হারানো এমন মানুষের সংখ্যা হরহামেশায় দেখা যায়। খাসপুকুরিয়া স্টিল ব্রিজ থেকে দেওয়ানগঞ্জ বাজার পর্যন্ত পুড়ো সড়কজুড়ে দেখা যায়, নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি, জমিজমা হারানো মানুষের বসতি। সড়কের দুইপাশে সারি-সারি ঝুপড়ি ঘর তুলে তারা মানবেতর বসবাস করছে। এখানে বসবাসকারীদের অবস্থা অনেকটা পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের আসমানী কবিতার রসুলপুর গ্রামের মতো।’উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সড়ক, মানুষের বাড়ি, জমির পাশে নদী ভাঙনে সব হারানো মানুষের বসবাস। আগে বন্যার সময় নদী ভাঙন দেখা দিলেও এখন জলবায়ুর পরিবর্তনে মাঝে মাঝেই খেপে ওঠে যমুনা।
নদীর বুকে চর জেগে গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় প্রবল বেগে ভাঙে দুইপাড়। বারো মাসই উপজেলার দুইপাড়ে নদী ভাঙছে। এভাবে নদী ভাঙনে কৃষি জমি আর বসতভিটা হারিয়ে মানুষ গরিব হচ্ছে। একই সাথে গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হওয়ায় জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব দেখা যায় এখানে।’সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে চৌহালী উপজেলা গঠিত। এগুলো হচ্ছে- সৌদিয়া চাঁদপুর, স্থল, ঘোরজান, খাসকাউলিয়া, খাসপুকুরিয়া, বাঘুটিয়া, ওমারপুর। এসব ইউনিয়নের সিংহভাগ গ্রামের নাম আছে। তবে বাস্তবে সেসব গ্রামের নদী ভাঙনে হারিয়ে গেছে। ভোটার তালিকায় এসব গ্রাম এবং মানুষের ঠিকানা থাকলেও বাস্তবে নেই।’
নদী ভাঙনে এলাকার মানুষ সব হারিয়ে পার্শর্¦বর্তী টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন স্থানে নতুন বসতি গড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এ উপজেলাকে নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কথা শোনা গেলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। যার কারণে প্রতিনিয়ত নদী ভাঙনে মানচিত্র থেকে ক্রমশ বিলীন হতে যাচ্ছে চৌহালী উপজেলা।চৌহালী উপজেলার উমারপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল মতিন জানান, আমার ইউনিয়নের শৈলজানা, চান্দইর, ধুপুলিয়া, আটসিংগুলী, উমারপুর, সিংগুলী, বিরিদাসুরিয়া, বাওসা, কাঠালিয়া, ধুপগাঁতীসহ অন্তত ১৫টি গ্রাম যমুনা নদীতে হারিয়ে গেছে। এসব গ্রামের নাম আছে তবে বাস্তবে নেই। মানুষজন অন্যত্র চলে গেছে।
এভাবে ভাংতে থাকলে আমার ইউনিয়নের কোন চিহ্নই থাকবে না।’নদী ভাঙনে চৌহালী উপজেলার আয়তন কমে আসার কথা স্বীকার করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন জানান, দিন দিন আমার উপজেলার গ্রাম জনপথ নদী ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ উপজেলার ২০ থেকে ২৫ ভাগ মানুষ অন্য জেলায় চলে গেছে। বাকি ঘরবাড়ি হারা মানুষ খুব বিপদে আছে। নদী ভাঙনের হাত থেকে এ উপজেলাকে বাঁচাতে হলে নদী ড্রেজিং করে গতিপথ পরিবর্তনসহ স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।’