ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক: নিউ ইয়র্কে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ডে প্যারেডে অংশ নিয়ে গালি খেলেন মেয়র এরিক অ্যাডামস। স্থানীয় সময় রোববার (২৬ মে) জ্যাকসন হাইটসের ৬৯-৮৭ স্ট্রিটের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি আর অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি পুলিশ উক্ত প্যারেডে অংশ নেন। সাধারন মানুষের চেয়ে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি পুলিশের উপস্থিতির নেপথ্যেও রয়েছে নানা তথ্য।
নিউ ইয়র্কে বসবাস করেন তিন লক্ষাধিক বাংলাদেশি। এখানে রয়েছে প্রায় তিন শতাধিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। আয়োজকদের খামখেয়ালীপনার কারণে বাংলাদেশ ডে প্যারেড স্বল্প সংখ্যক প্রায় দেড় শতাধিক প্রবাসী আর প্রায় দুই শ’র মতো বাংলাদেশি পুলিশের উপস্থিতি দেখে হতাশ হয়েছেন প্রবাসীরা। একটি নির্ভরযোগ্য সুত্র জানিয়েছে, ছুটির দিনে পোষাক পরে কোন পুলিশ ডিউটি করলে বেতন পান দেড় গুণ এবং ছুটির দিন কাজ করার বিপরীতে আরও একদিন ছুটি পাবেন। সেই হিসেবে বেতনের পরিমাণ দাঁড়ায় আড়াই গুণ। এ কারণেই পুলিশ, কারেকশন বিভাগসহ ও অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তারাও উক্ত ডে প্যারেডে ছুটে আসেন বলে সূত্রটি উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রস্থ বিশ্ব মানবাধিকার উন্নয়ন সংস্থার আয়োজনে বাংলাদেশ ডে প্যারেডের ১ সপ্তাহ আগে থেকে কে হবেন ‘গ্র্যান্ড মার্শাল’ এ নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের মধ্যে শুরু হয় টানা হেঁচড়া। অবশেষে প্যারেডের গ্র্যান্ড মার্শাল পদ বতিল করেন কর্তৃপক্ষ।
প্যারেডে প্রধান অতিথি ছিলেন নিউ ইয়র্কের মেয়র এরিক অ্যাডামস। ইসরায়েলের সমর্থনকারী নিউ ইয়র্কের সিটি মেয়রের বক্তব্য চলাকালীন সময় তাকে উদ্দেশ্য করে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন দেশীয় নাগরিকরা তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। এ সময় তিনি সাটআপ বলে তদেরকে থামতে বলেন। শ্লোগান বাড়তে থাকলে তরিঘড়ি করে বক্তব্য শেষ করেন তিনি।
নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যাদের অবদান রয়েছে তাদেরকে সেভাবে কোন আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ছিল না নতুন প্রজন্মের কোন সম্পৃক্ততা। নিউ ইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ড ও চেয়ারম্যানকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করায় উক্ত প্যারেডে অংশ নেননি বাংলাদেশ সোসাইটি। অংশ নেননি বড় বড় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। চরম অব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশি মুলধারার রাজনীতিবিদরাও কেউ প্যারেডে আসেননি। এর জন্য আয়োজকদের খামখেয়ালীপনা ও উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রচুর সংখ্যক মানুষ বসবাস করেছেন নিউ ইয়র্কে। তাদের অনেকেই জানিয়েছেন তার প্রতি মুহুর্তে টিভিতে ঘূর্ণিঝড়ের খবর শুনছেন। দেশে আত্মীয় স্বজনদের খবর নিচ্ছেন। তাদের মতে বাংলাদেশ প্যারেডে গিয়ে আমাদের কি হবে।
সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন প্রচারণায় আয়োজকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ডে প্যারেডকে নিউ ইয়র্কে এই প্রথমবার উল্লেখ করে নানা প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকৃত পক্ষে নিউ ইয়র্কে এটা দ্বিতীয় বাংলাদেশ প্যারেড। আশির দশকের প্রথমার্ধে সম্ভবত ১৯৮৪ সালে নিউ ইয়র্কে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ডে প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী আনিসুজ্জামান খোকনের রুপসী বাংলার আয়োজনে প্রথমবারের উক্ত প্যারেডে গ্রান্ড মার্শাল ছিলেন যথাক্রমে-নাসির খান পল, তহুর আহমেদ ও ডা. বিল্লাহ। উক্ত প্যারেডে গান গেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রবাসী কণ্ঠযোদ্ধা শহীদ হাসান। এরপর ডা. হামিদ্দুজ্জামান ও ফখরুল আলমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সোসাইটির আয়োজনে ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবারের বাংলাদেশ ডে প্যারেডের আয়োজকরা অত্যন্ত চতুরতার সাথে প্রবাসীদের সাথে প্রতারণা করেছেন অভিযোগ ওঠে।
জ্যাকসন হাইটসের ৩৭ এভ্যেন্যুর ওপরে ৬৮-৬৯ স্ট্রিটে প্যারেড চলাকালীন সময়ে সামনে গিয়ে মেয়র এরিক অ্যাডামসের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করলে সময় টিভির যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি হাসানুজ্জামান সাকীকে গোয়েন্দা পুলিশ ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময়ে মেয়র কোন টিভির জন্য বক্তব্য দিতে গেলে প্যারেড থেমে যেত। ঐ সময়ে মেয়রের বক্তব্য নিতে চাওয়াটা অশোভনীয় বলে মন্তব্য করেন বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।
এদিকে, প্যারেডের ‘গ্র্যান্ড মার্শাল’ তা নিয়ে গত ১ সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের মধ্যে টানা হেঁচড়ার পর অবশেষে প্যারেডের গ্র্যান্ড মার্শাল পদ বতিল করেন আয়োজক সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রস্থ বিশ্ব মানবাধিকার উন্নয়ন সংস্থা।
গত বুধবার ২২ মে স্মার্ট টেক-এ অনুষ্ঠিত সভায় আহবায়ক শাহ নেওয়াজ কর্তৃক বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ড ও চেয়ারম্যান এম এ আজিজকে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করেন। শাহ নেওয়াজ বলেন, বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ড হলো ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। তার এ মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান উপস্থিত বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রব ও সাধারন সম্পাদক রুহুল আমীন সিদ্দিকী। তারা তাৎক্ষণিক এ ধরনের মন্তব্য প্রত্যাহারেরও দাবি করেন। এর আগে আয়োজকরা বাংলাদেশ সোসাইটির কাছ থেকে অর্থ সাহায্য চাইলে কমিটির সিদ্ধান্তের পর তা জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন সোসাইটির নেতারা। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সোসাইটি উক্ত প্যারেডে অংশ নেননি বলে জানান ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এ আজিজ। শুধু তাই নয় গ্র্যান্ড মার্শাল নির্ধারনের বিষয়ে আপত্তি করায় যুগ্ম আহবায়ক সৈয়দ আকিকুর রহমান ফারুকের গায়ে হাত তোলেন আহবায়ক শাহ নেওয়াজের স্ত্রী রানো নেওয়াজ।
ফারুক বলেন, উপস্থিত সবার সামনেই একজন মহিলা তার গায়ে হাত তুলেছে। কিন্তু কেউই তেমনভাবে কোন প্রতিবাদ করেনি। তাকে অপমানিত করার জন্য তিনি বিচার চেয়েছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ডে প্যারেডের আহ্বায়ক শাহ নেওয়াজের সাথে মুঠোফোনের বার্তায় যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সোসাইটি প্যারেডে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সোসাইটি প্যারেডে অংশ নেননি। তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশ ডে প্যারেডে কোন গ্র্যান্ড মার্শাল থাকবে না। অথচ তিনি নিজের ইচ্ছায় গ্র্যান্ড মার্শাল সেজে মঞ্চে উঠে নিজেই ঘোষণা দেওয়ার চেষ্টা চালান। এ সময় তাকে থামিয়ে দেন গিয়াস আহমেদ ও ফাহাদ সোলায়মান। এ নিয়ে মঞ্চেই গিয়াস আহমেদের সাথে আহবায়ক শাহ নেওয়াজের স্ত্রী রানো নেওয়াজের বাক-বিতন্ডা হয়।
বাংলাদেশ ডে প্যারেডের চেয়ারপারসন শাহ শহিদুল হক সাঈদের সাথে মুঠোফোনের বার্তায় যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য দেননি। তবে সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সোবহান বাংলাদেশ সোসাইটি প্যারেডে অংশ নেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।
বাংলাদেশ সোসাইটির ট্রাস্টি বোর্ডসহ চেয়ারম্যান এম এ আজিজ বলেন, বাংলাদেশ সোসাইটি প্যারেডে অংশ নেননি। সোসাইটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ফলেই কেউ সেখানে যাননি। সোসাইটির সাবেক কোন কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে থাকলে এটার জন্য সোসাইটি দায়ী না।
তিনি উল্লেখ করেন গ্র্যান্ড মার্শাল পদের জন্য বিশ্ব মানবাধিকার উন্নয়ন সংস্থার প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ ডে প্যারেডের চেয়ারপারসন শাহ শহিদুল হক সাঈদ তার কাছ থেকে ৫০ হাজার ডলার দাবি করেছিলেন। তিনি এত পরিমাণ অর্থ দিতে অপারগতা প্রকাশ করার পর থেকেই গ্র্যান্ড মার্শাল পদের জন্য বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের মধ্যে শুরু হয় টানা হেঁচড়া। শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্ড মার্শাল পদ বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা।