September 20, 2024 - 5:43 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeকর্পোরেট ভয়েসরিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ

রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, চেয়ারম্যান, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ

spot_img

নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোংলা বন্দর লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত ছিল। দীর্ঘ ১৮ বছর লোকসানের বোঝা টানার পর মোংলা বন্দর এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের নেক নজর এবং এ বন্দর ব্যবহারকারীদের সদিচ্ছায়। মোংলা বন্দরের লাভ-লোকসানের ইতিকথা আর এ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানালেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। 

প্রশ্ন : নৌবাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও আপনি প্রেষণে চট্টগ্রাম বন্দর, খুলনা শিপইয়ার্ড ও মোংলা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন—এ বিষয়টি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

চেয়ারম্যান : এ জন্য আমি প্রথমে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। এ ছাড়া সরকারের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। কারণ সরকার আমাকে এ সুযোগ দিয়েছে। নৌবাহিনীর সদস্য হিসেবে যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমার ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছে তাতে যেকোনো সময় আমার পদবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নৌবাহিনীতে যেকোনো দায়িত্ব পালনে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং আমি প্রেষণে চাকরির অভিজ্ঞতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকি। প্রেষণে আমি যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছি/করছি তার প্রতিটিতে প্রতিনিয়ত নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেকাংশে উন্নত হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন : আমাদের আমদানি-রপ্তানি প্রধানত নৌপথে হয়ে থাকে এবং মোংলা বন্দর দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর হওয়া সত্ত্বেও কেন এটা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল?

বন্দর চেয়ারম্যান : আমাদের আমদানি-রপ্তানির ৯৮ শতাংশ সমুদ্রপথে অর্থাৎ সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আশ্চর্যজনক অথবা হতাশাজনক হলেও এটা সত্য যে দেশে দুটি সমুদ্রবন্দর থাকা সত্ত্বেও সমুদ্রপথের আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা একটিমাত্র বন্দর অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। নিম্নবর্ণিত কারণে এ বন্দর ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি বলে আমি মনে করি : ১. ইতিপূর্বে এ বন্দরের সেবার মান বৃদ্ধিকল্পে বন্দর, কাস্টমস ও ব্যাংক সুবিধাবলি ব্যবসাবান্ধব করার ব্যাপারে সময়োপযোগী উদ্যোগের অভাব ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ বন্দরটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ছিল; ২. সরকার কর্তৃক বন্দরের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তাদের এ বন্দরে কাজ করার অনাগ্রহ;৩. মোংলা বন্দরের সঙ্গে Hinterland-এর নৌপথে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হলেও সড়কপথের যোগাযোগব্যবস্থা উপযোগী নয়। এ ছাড়া রেল যোগাযোগ আজও গড়ে ওঠেনি।

প্রশ্ন : সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এ বন্দরে কাজ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?

বন্দর চেয়ারম্যান : উদাহরণস্বরূপ বিগত ৬৫ বছরে এখানে মোট ৪৬ জন প্রধান নির্বাহী/চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১৯ জন অতিরিক্ত/চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বন্দর একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। সিভিল/মিলিটারি যে সার্ভিস থেকেই এখানে যাকে নিয়োগ দেওয়া হোক তাঁকে কিন্তু উন্নয়নমূলক কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার আগে বন্দর সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা অর্জন করতে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়। কাজেই একজন চেয়ারম্যান/সদস্যের ন্যূনতম তিন-চার বছর এ-জাতীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : এ মুহূর্তের মোংলা বন্দরকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

বন্দর চেয়ারম্যান : ২০০৯ সাল থেকে মোংলা বন্দরের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকার এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে বন্দর ব্যবহারকারীরা আগের চেয়ে বন্দর ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহী হচ্ছে। প্রতিবছরই আমাদের কার্যক্রম আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই বছর ধরে আমাদের কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ২৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে। এটা উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি। আমি আশা করি, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে। ২০১৮-পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতু চালু, খুলনা-মোংলা বন্দর রেল যোগাযোগ স্থাপন, ফয়লায় বিমানবন্দর চালু, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু এবং বেজার (BEZA) কার্যক্রমসহ বিভিন্ন প্রাইভেট শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে—এ সবকিছুতে মোংলা বন্দরের প্রবৃদ্ধি আরো উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। তখন মোংলা বন্দর জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে—বিশেষজ্ঞমহলও তাই মনে করে।

প্রশ্ন : ২০১৮ এবং এর পরবর্তী সময়ে যে প্রবৃদ্ধি আপনি আশা করছেন সে অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বন্দরের সুযোগ-সুবিধা তথা সেবার মান অনেক উন্নত হওয়া প্রয়োজন বলে বন্দর ব্যবহারকারীরা মনে করেন। এ ব্যাপারে বন্দরের পরিকল্পনা কী?

বন্দর চেয়ারম্যান : ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। এতে বন্দরের সেবার মান আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো। আরো কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, যা ২০১৮-এর মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে বন্দরে আমরা আরো উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে পারব। এ ছাড়া আরো কিছু মধ্যমেয়াদি প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যেগুলো ২০২০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এই মধ্যমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০২১-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হব বলে আশা করছি। পরিকল্পিত এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রধান প্রকল্পগুলো হচ্ছে : ক. প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপে একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা—এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। শিগগিরই এর নির্মাণকাজ শুরু হবে। খ. অটোমেশন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করণ—প্রকল্পটি বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। গ. দূষণ রোধকল্পে Spilled Oil Collection Vessel সংগ্রহ—এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ঘ. Vessel Traffic Management & Information System স্থাপন—এ প্রকল্পটি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। চলতি ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন হলে আগামী জানুয়ারি ২০১৭-এ আমরা টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করব। ঙ. চীনা অর্থায়নে আটটি কম্পোনেন্টের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন—এ প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে সরকারি চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করা যাবে বলে আশা করা যায়। এ প্রকল্পের প্রধান কয়েকটি অংশ হলো : (১) একটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ; (২) একটি কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ; (৩) একটি বহুতল কার ইয়ার্ড নির্মাণ; (৪) বন্দর চ্যানেলে অনেক পুরনো রেক (ডুবে থাকা কার্গো বার্জ) উত্তোলন।

প্রশ্ন : বিগত বছরগুলোতে যে বন্দর ব্যবহারকারীদের তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি সে বন্দর আগামী দিনে কিভাবে তাদের আকৃষ্ট করবে?

বন্দর চেয়ারম্যান : যেকোনো সমুদ্রবন্দরের প্রধান তিনটি দিক থাকে—চ্যানেলের নাব্যতা, বন্দর ও কাস্টমস সুবিধা এবং বন্দর থেকে গন্তব্যস্থলের যোগাযোগব্যবস্থা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘদিন ধরে সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের অবহেলার কারণে দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর হওয়া সত্ত্বেও ওই তিনটি দিকের কোনোটিই যথাযথভাবে উন্নয়ন/রক্ষণাবেক্ষণ না করায় মোংলা বন্দর প্রয়োজনীয়সংখ্যক ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তবে ২০০৯ সাল থেকে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তিনটি দিকই যথেষ্ট উন্নয়ন করা হয়েছে/হচ্ছে, যার অধিকাংশই ২০১৮-১৯-এর মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাস্তবায়িত ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কারণে এরই মধ্যে আমরা অভূতপূর্ব সুফল পেতে শুরু করেছি। আপনারা জেনে অবাক হবেন, আমাদের বিগত দুই বছরের কার্গো হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি ২৮ শতাংশ। এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এটা প্রকাশ পেয়েছে যে শুধু পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হলে মোংলা বন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং আরো উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। আরেকটি বিষয় আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে বন্দর ট্যারিফ ক্ষেত্রবিশেষে আমরা আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবসাবান্ধব করেছি। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ২০১৮-এর পর মোংলা বন্দরে স্থাপিত শিল্প-কারখানার মালিক ও বন্দর ব্যবহারকারীদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।

প্রশ্ন : সমুদ্রবন্দরের প্রধান যে তিনটি দিকের কথা আপনি বলেছেন, মোংলা বন্দর সংশ্লিষ্ট, এগুলোর উন্নয়নের মাধ্যমে মোংলা বন্দর ভবিষ্যতে ব্যবহারকারীদের কতটা উন্নত সেবা দিতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?

বন্দর চেয়ারম্যান : প্রথমত, নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা এরই মধ্যে হারবার এলাকার ড্রেজিং সম্পন্ন করেছি। বন্দর এলাকা থেকে রামপাল পর্যন্ত এলাকার ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং আউটার বার এলাকার ড্রেজিং প্রকল্প সরকারের অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রকল্প দুটি ২০১৮-১৯-এর মধ্যে আমরা সম্পন্ন করব। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নের ফলে বর্তমান ৮.৫ মিটার ড্রাফটের পরিবর্তে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এ বন্দরে আসতে পারবে। আধুনিক সুযোগ- সুবিধাসহ কনটেইনার টার্মিনাল, বহুতল কার ইয়ার্ড, বন্দর এলাকার রাস্তা ছয় লেনে উন্নয়ন, আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থা, অটোমেশন ইত্যাদি প্রকল্প পর্যায়ক্রমে ২০১৮-২০ সালের মধ্যে সম্পন্নের মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে বলে আমি আশাবাদী। দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে সড়কপথে ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার কম হবে। ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক বেশ কিছু কার্গো বিশেষত গার্মেন্টসামগ্রী এ বন্দরের মাধ্যমে পরিবাহিত হওয়ার একটি সহজ সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া খুলনা-মোংলা রেল যোগাযোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রেলপথেও মোংলা বন্দরের কার্গো পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এভাবে তিনটি দিকই উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে মোংলা বন্দর ২০১৮-১৯ থেকে এ বন্দর ব্যবহারকারীদের অত্যন্ত উন্নত সেবা প্রদানে সক্ষম হবে বলে আমি মনে করি।

প্রশ্ন : দেশি-বিদেশি কিছু মহল মনে করে, সুন্দরবন রক্ষার স্বার্থে ড্রেজিং কার্যক্রমসহ মোংলা বন্দরের উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখা উচিত। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?

বন্দর চেয়ারম্যান : নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়ে আমার মতামত হলো : ক. প্রথমত, মোংলা বন্দর এমন কোনো বন্দর নয়, যা আমরা নতুনভাবে নির্মাণ করছি। বরং এটা আমাদের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর, যা আমরা বিগত ৬৬ বছর ধরে ব্যবহার করছি। খ. দ্বিতীয়ত, এ বন্দর নির্মাণের সময় সুন্দরবনের গুরুত্ব এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই দেশি-বিদেশি একাধিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের আলোকেই এ বন্দরের সব উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। গ. তৃতীয়ত, সুন্দরবন অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং World Heritage হিসেবে স্বীকৃত। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। কাজেই এর নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের চেয়ে অন্য কারো অধিক উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ঘ. চতুর্থত, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং স্বভাবতই আমাদের উন্নয়ন আমদানি-রপ্তানির ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের বর্তমান GDP প্রবৃদ্ধি যেখানে ৭.১১ শতাংশ সেখানে আমাদের সমুদ্রপথের Trade প্রবৃদ্ধি ২২% শতাংশের ওপরে। আমাদের Trade-এর ৯৮ শতাংশই সমুদ্রপথে পরিবাহিত হয়। এই বিশাল Trade-এর সিংহভাগ এখনো আমাদের প্রধান সমুদ্রবন্দর অর্থাৎ চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আমরা এও জানি, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবস্থায় আমাদের Trade Growth-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার একার পক্ষে চলা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণেই দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত রাখার লক্ষ্যে আমাদের Trade তথা আমদানি-রপ্তানি সহজতর রাখার লক্ষ্যে দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর তথা মোংলা বন্দরের পরিকল্পিত উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ঙ. পঞ্চমত, মোংলা বন্দর একটি Tidal Port বিধায় বন্দর চ্যানেলে পলি পড়ার হার অনেক বেশি এবং পশুর নদের তীর ভাঙার কারণে Occassional ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে এ বন্দরের নাব্যতা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাব্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই Occassionalড্রেজিং এই চ্যানেলের প্রয়োজনীয় পানির প্রবাহ ও পরিমাণ নিশ্চিত করে বলে এটা সুন্দরবন এলাকার জীববৈচিত্র্যের জন্য সহায়ক বলেই আমার মনে হয়। চ. ষষ্ঠত, যেকোনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য একটি বন্দরের ওপর নির্ভরশীল থাকা Strategic দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কাজেই বিকল্প একাধিক সমুদ্রবন্দর যেকোনো Meritime Nation-এর জন্য অপরিহার্য। এ ছাড়া যেহেতু চট্টগ্রাম বা মোংলা কোনো বন্দরেই বড় জাহাজ যেতে পারে না এবং দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে বর্ধিত Trade Growth বিবেচনায় নিয়ে অনেক বড় জাহাজ আগমনের সুবিধার্থে পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বার্থে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে আরো একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের আবশ্যকতাও দেখা দিতে পারে। ছ. সবশেষ কথা : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০২১ এবং ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে মোংলা বন্দরের টেকসই উন্নয়ন এবং সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার বিষয় পাশাপাশি চলমান রাখতে হবে।

প্রশ্ন : পর্যায়ক্রমে মোংলা বন্দরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেবার মান বৃদ্ধি পেলেও কাস্টমসের সেবার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় সামগ্রিকভাবে বন্দর ব্যবহারে অনেক ব্যবহারকারীর অনাগ্রহের কথা শোনা যায়। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

বন্দর চেয়ারম্যান : সমুদ্র, বিমান বা স্থল যেকোনো বন্দরেই বন্দর ও কাস্টমস সুবিধা উন্নত ও দ্রুততর না হলে সে বন্দর ব্যবহারে ব্যবহারকারীদের অনাগ্রহ থাকবে—এটা খুবই স্বাভাবিক। মোংলা বন্দরও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে একটি বিষয় আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, সেবার মান উন্নয়ন একটি Continuous Process। মোংলা কাস্টমসের বেশ কিছু সফলতা কিন্তু এরই মধ্যে হয়েছে। মোংলা ইপিজেড ও মোংলা বন্দরের বেশ কিছু কক্ষ ভাড়া নিয়ে তারা খুলনার পাশাপাশি মোংলায় তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ছাড়া তাদের পূর্ণাঙ্গ অফিস ও আবাসিক ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে মোংলা বন্দরের বেশ কিছু জমি এরই মধ্যে তারা লিজ নিয়েছে এবং নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমার জানা মতে, দ্রুততার সঙ্গে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর নিকট ভবিষ্যতে খুলনা থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে তারা মোংলায় স্থানান্তর করবে। অন্য একটি বিষয় হচ্ছে, মোংলা বন্দরে এখনো কোনো কনটেইনার স্ক্যানার না থাকায় কনটেইনার আমদানীকৃত পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের অভিযোগ-অনুযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এ ব্যাপারেও আমি জানি যে মোংলা কাস্টমস এরই মধ্যে প্রথম স্ক্যানারটি সংগ্রহ করেছে, যা বর্তমানে বন্দর এলাকায় সংরক্ষিত আছে এবং এটি স্থাপনের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এটি স্থাপনের পর বন্দরের সেবার মান উন্নত হবে। আমি এও জানি, আরো অধিকসংখ্যক কনটেইনার স্ক্যানার ক্রয় ও স্থাপনের পরিকল্পনা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আছে। এ ছাড়া জনবলস্বল্পতার বিষয়টিও তারা পর্যায়ক্রমে সমাধান করছে।

প্রশ্ন : পায়রা বন্দরের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু হলে মোংলা বন্দরের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা কমে যাবে—একটি মহলে এমন নেতিবাচক কথা শোনা যায়। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?

বন্দর চেয়ারম্যান : একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের উন্নয়ন প্রধানত আমদানি-রপ্তানি নির্ভরশীল। আমাদের সমুদ্রপথের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশের ঊর্ধ্বে। এ ছাড়া এ অঞ্চলের আমাদের বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশ তাদের প্রয়োজনে ও সুবিধার্থে আমাদের সমুদ্রবন্দরগুলো ব্যবহার করবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আমাদের সরকারের বিভিন্ন ধরনের চুক্তি/সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরও হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পাবে। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেশের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আগত তুলনামূলক ছোট জাহাজের পাশাপাশি বৃহদাকার জাহাজ আনার সুবিধা সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। প্রধানত এ কারণেই পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। এ বন্দর পূর্ণাঙ্গরূপে নির্মিত হওয়ার পর আমাদের দেশের জন্য চতুর্থ বন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিতে পারে। কাজেই আমি মনে করি উন্নয়নশীল Meritime Nation হিসেবে আমাদের তিন-চারটি সমুদ্রবন্দর থাকা দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন বিধায় কোনো বন্দরের প্রয়োজনীয়তাই শেষ হবে না।

প্রশ্ন : আমাদের দেশের সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোংলা বন্দরের ভূমিকা বা উন্নয়ন পরিকল্পনা কী?

বন্দর চেয়ারম্যান : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১-এর অর্থ হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। স্বভাবতই এ ভিশন সামনে রেখে দেশের সব মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছে/করছে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। আমাদের চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি Strategic Master Plan নামে একটি প্রকল্প এরই মধ্যে আমরা হাতে নিয়েছি। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এ প্রকল্প সম্পন্ন হবে বলে আমরা আশা করছি। ওই Strategic Master Plan অনুযায়ী আমরা পরিকল্পিত কিছু অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান আরো উন্নত করব। সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার মাধ্যমে পরিকল্পিত উপায়ে ২০৪১ সালের আগেই মোংলা বন্দর একটি উন্নত ও আধুনিক সমুদ্রবন্দরে পরিণত হবে।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ