নন্দ গোপাল চক্রবর্তী।। এ কথা সবার জানা যে, ব্যবসার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে এক মালিকি কারবার, মূলধনের অপর্যাপ্ততার জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে অংশীদারী কারবার আর সবশেষে অংশীদারদের অসীম দায় সীমিত করার প্রয়োজনে ঊণবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সীমাবদ্ধ দায় ও কাল্পনিক স্বতন্ত্র স্বত্বা বিশিষ্ট লিমিটেড কোম্পানীর উদ্ভব। এরপর প্রায় একশ বছর কেটে যাওয়ার পরে অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গেল লিমিটেড কোম্পানীতে সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের রক্ষাকবচ অপ্রতুল, বহুজনের হিতের জন্য একক ব্যক্তির উদ্যম ও সৃজনশীলতা সেখানে বাধাগ্রস্ত, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র বিস্তৃত একক কোম্পানীর একচেটিয়া কর্তৃত্বে মানবপ্রজাতির অসহায় অবস্থা আর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির দেওয়ানিসহ জঘন্য ফৌজদারি অপরাধ করার পরেও কাল্পনিক স্বতন্ত্র স্বত্বার পর্দার পেছনে নিজেকে আড়াল করার অবারিত সুযোগ। আর তাই আবার বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে শুরু হলো উল্টোযাত্রা। সীমাবদ্ধ দায়ের যে স্বাদ ব্যবসায়ী সমাজ এতদিন পেয়ে এসেছে তাকে অক্ষুন্ন রেখে সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট অংশীদারী কারবার (এলএলপি) ও একমালিকি (ওপিসি) কারবারের পুনরাবির্ভাব।
একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে নতুন করে দেশে দেশে সরকারী আইনী পৃষ্ঠপোষকতায় এলএলপি ও ওপিসির উদ্ভব হচ্ছে আর ক্রমেই তার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে যদিও এলএলপি এখনো হয়নি তবে ২০২০ সনের ২৪নং আইন দিয়ে কোম্পানী আইন ১৯৯৪ এর যে সমস্ত ধারা সংযোজন সংশোধন করা হয়েছে তার মধ্যে ’এক ব্যক্তি কোম্পানী’ বা ওপিসি উল্লেখযোগ্য। এটি সময়োপযোগী ও প্রত্যাশিত ছিল।
সীমাবব্ধ দায় ও স্বতন্ত্র স্বত্বা ছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশে ওপিসি’র যে আইনানুগ চেহারা দেওয়া হয়েছে তা সংক্ষেপে এ রকম: (১) মালিক হবে কেবলমাত্র রক্তমাংসের একজন প্রাকৃতিক মানুষ; (২) পরবর্তীতে প্রয়োজনে পরিবর্তনযোগ্য একটি সংঘস্মারক ও একটি সংঘবিধি থাকবে; (৩) নিবন্ধন প্রক্রিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এর মতই হবে; (৪) কোম্পানীর নামের শেষে ’ওপিসি’ থাকতে হবে; (৫) কোম্পানীর কাজ পরিচালনার জন্য মালিক তার অবর্তমানে সংঘস্মারকে উল্লেখপূর্বক অন্য কাউকে তার লিখিত সম্মতিক্রমে মনোনীত করতে বা তার পরিবর্তে অন্য কাউকে মনোনয়ন দান করতে পারবেন; (৬) মূলধন ন্যুনতম ২৫ লাখ সর্বোচ্চ ৫ কোটি এবং পূর্ববর্তী বছরের বার্ষিক টার্ণওভার ন্যুনতম ১ কোটি সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা; (৭) মূলধন বা বার্ষিক টার্ণওভারের সর্বোচ্চসীমা অতিক্রম করলে ওপিসিটিকে প্রাইভেট লিমিটেড বা ক্ষেত্রমত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীতে রুপান্তর করা যাবে; (৮) মালিক নিজেই একমাত্র শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক তবে প্রয়োজনে ম্যানেজার, সচিব ইত্যাদি নিয়োগ করা যাবে; (৯) প্রতি ক্যালেন্ডার (জানু-ডিসে) বছরে কমপক্ষে একটা পরিচালক সভা করতে হবে; (১০) শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রাইভেট কোম্পানীতে প্রযোজ্য বিধিনিয়ম মানতে হবে; (১১) প্রতি অর্থ বছরের জন্য নিরীক্ষিত ব্যালান্সশীট ও লাভক্ষতি হিসাব দাখিল করতে হবে; (১২) ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় জামানত প্রদান সাপেক্ষে ঋণ গ্রহন করতে পারবে; আর (১৩) বিধিবিধান মেনে কোম্পানীটির স্বেচ্ছাকৃত অবলুপ্তি ঘটানো যাবে।
সংক্ষেপে ওপিসি’র যে ১৩টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হলো তার মধ্যে অন্যদের কথা বাদ দিয়ে আমাদের দেশের লাখ লাখ ওপিসি-যোগ্য ব্যবসায়ীর বর্তমান সুবিধা অসুবিধার বাস্তব প্রেক্ষাপটে ২/১টি ব্যাপার পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে। যেমন- টার্ণওভারের ন্যুনতম ও সর্বোচ্চসীমা সীমা তুলে দেওয়া, মূলধনের ন্যুণতম সীমা তুলে দেওয়া ও সর্বোচ্চসীমা ১০ কোটি ছাড়ালে পরিস্কার করে বলা যে মালিক ও তার মনোনীত ব্যক্তিসহ ওপিসিটি প্রাইভেট কোম্পানীতে রুপান্তরণ, নিবন্ধন নিয়ম বাংলায় অনলাইনে সহজীকরণ ও পরিশোধিত মূলধনের উপর নামমাত্র ফি নির্ধারণ।
বর্তমানে ওপিসি’র আবির্ভাবে বাংলাদেশে সরকার ও ক্ষুদ্র/মাঝারি ব্যবসায়িদের জন্য যে অভুতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় আরো কিছু সংস্কার নীতি নিয়ম করতে পারলে আকাংখিত মাথাপিছু আয়, কর জিডিপি’র অনুপাত বাড়বে, স্বনিয়োজিত স্বকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ফলে সবাই উপকৃত হবে। সমস্ত লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে হলে ওপিসি’র আয়কর ও ভ্যাটহার হবে ব্যক্তিহারের অর্ধেক, ঋণের উপর সুদহার বিধিবদ্ধহারের অর্দ্ধেক, অন্যান্য লাইসেন্স ফি হবে অর্ধেক। কম্পিউটার ও ওপিসির জন্য উপযোগী সফটওয়্যার নামমাত্র মূল্যে সরবরাহ ও তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। বানিজ্য ও অর্থ মন্ত্রনালয়ে ও পিসি’র জন্য আলাদা বিভাগ খুলতে হবে।
মোটকথা হচ্ছে যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িটিকে এতদিন আইন কর্তৃত্ব দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে তাঁর অবদানের কথা ভুলে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে সমাজ কেবল নিয়েই এসেছে সেকথা আমাদের প্রথমেই স্বীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত তাকে প্রাথমিকভাবে যথাসম্ভব নীতি সহায়তা ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাকে সাহায্য করলে ব্যক্তি হিসাবে সে নিজে ও আমরা সবাই উপকৃত হবো। পরবর্তীতে সে সামথ্য অর্জন করবে এবং তখন তাঁর কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা সমাজ বুঝে নিক। তার জন্য তাকে সময় দিতে হবে। তাহলে ওপিসি’র এই আইন প্রণয়ন সার্থক হবে।
লেখক: এন জি চক্রবর্তী, গবেষক কোম্পানি ল, পেশাদার হিসাববিদ ও সহ প্রতিষ্ঠাতা, আইসিএসবি।