কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক : চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকে রেলের সাথে কক্সবাজার সংযুক্ত হলো। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে সত্যি আমি খুব আনন্দিত। একটা কথা দিয়েছিলাম, কথাটা রাখলাম। আজকের দিনটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটা গর্বের দিন।’
শনিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে দোহাজারী-কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, কক্সবাজার এমন একটি সমুদ্র সৈকত, যেটা বিশ্বে বিরল, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। ৮০ মাইল লম্বা, সম্পূর্ণটাই বালুকাময়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘অনেকের আশা ছিল ট্রেনে কক্সবাজারে আসবে, সে ব্যবস্থা করেছি। এখন উত্তরবঙ্গসহ, পঞ্চগড়, খুলনা ও রাজশাহী থেকে যাতে আসতে পারে সে ব্যবস্থা করব।’
ক্ষমতার লোভে দেশের সম্পদ কারও হাতে তুলে দিতে রাজি হয়নি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০০১ সালে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্যাস বহির্বিশ্বের কাছে বিক্রি করতে রাজি হয়নি, তাই আমাকে একটি চক্র পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি।
তিনি বলেন, তিনি নিজেসহ দেশবাসী এখন কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়, রাজশাহী, দেশের দক্ষিণাঞ্চল, সুন্দরবন পর্যন্ত রেলপথ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। মজার সুরে তিনি আরও বলেন, ‘কেন গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গিপাড়াকে ছেড়ে দেওয়া হবে (রেল সংযোগ থেকে) তার মানে সারা বাংলাদেশ কক্সবাজারের সঙ্গে যুক্ত হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, পঞ্চগড় থেকে কক্সবাজার অথবার রাজশাহী থেকে কক্সবাজার, দক্ষিণাঞ্চল সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার এমনটি গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর অর্থাৎ সমগ্র বাংলাদেশ থেকেই যাতে সহজে কক্সবাজার আসা যায় সেই পদক্ষেপও আমরা নেব। এই যোগাযোগগুলো সম্পন্ন হলে আমাদের পর্যটনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি ছোটবেলা থেকেই স্থানীয় একটি দাবি শুনে এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন ছিল। কাজেই এই দোহাজারী থেকে কক্সবাজার কবে রেললাইন আসবে? সেকথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে এটা করতে পারায় তিনি খুবই আনন্দিত। এটা রামু পর্যন্ত করা হয়েছে এবং গুমধুম পর্যন্ত করার কথা। এ জন্য আমরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসতে চাই। ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সাথে আমরা সংযুক্ত হতে চাই। সেটা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই প্রকল্প বাস্তায়নের সময় ৩৯টি মেজর ব্রীজ করতে হয়েছে, ২৪৪টি ছোটও মাঝারি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে, ৯টি স্টেশন ও আধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগনালিং ব্যবস্থা ইনস্টল করা হয়েছে। একটি ওভারপাস ও দু’টি আন্ডারপাস ও নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই রেললাইনটা চকোরিয়া থেকে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও পাওয়ার পাøান্ট এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথে যাতে সংযুক্ত হয় তার ব্যবস্থাও আমরা করে দেব। যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য আরো উন্নত হয়।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মিলে সম্প্রতি খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল চলাচলের উদ্বোধন করেছে। যে লাইনটা এক সময় খালেদা জিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
পাশাপাশি ঢাকা- টঙ্গি-গাজীপুর ডুয়েল গেজ লাইনও নির্মাণ করা হচ্ছে। রেলের যাত্রীসেবা ও পণ্য পরিবহনের মানোন্নয়নে আরো ৪৬টি নতুন ব্রডগেজ লোকামোটিভ, ৪৬০টি নতুন যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ২০০টি নতুন মিটার গেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ, ১৩১০টি নতুন ওয়াগন সরবারহের উদ্যোগও তাঁর সরকার হাতে নিয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ৩/৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাতে উন্নীত হয় সেই পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি এবং সেটা আমরা বাস্তবায়ন করবো।
বিগত ১৫ বছরের বাংলাদেশকে তাঁর সরকার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি আমলে যেখানে ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল সেখানে তাঁর সরকার এবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছে।
এমনকি দু’হাতে রিজার্ভের অর্থ ব্যয় করে করোনাকালিন জনগণকে বিনাপয়সায় ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি সকল শ্রেনী পেশার মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা ও প্রণোদনা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রেখেছে। যা অনেক উন্নত দেশও পারেনি। ফলে সেখানে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। এ সময় বিশ্ব মন্দার প্রভাবে দেশে যেন কখনো খাদ্যাভাব না হয় সেজন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য দেশবাসীর প্রতি তাঁর আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিন্টিং এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, বেলা ১১টায় বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে কক্সবাজারে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। এরপর কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। এ সময় রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কাছে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন ছয় তলাবিশিষ্ট আইকনিক রেলস্টেশন নির্মিত হয়েছে। ২৯ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭ বর্গফুটের। রেলস্টেশনটিতে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সুবিধা।
দৈনিক ৪৬ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আইকনিক রেলস্টেশনে আরও আছে ডাকঘর, কনভেনশন সেন্টার, তথ্যকেন্দ্র, এটিএম বুথ ও প্রার্থনার স্থান।
মূল ভবনের নিচতলার রাখা হয়েছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কক্ষ, লকার, তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী সেতুতে যাতায়াতের পথ। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয়।
১০১ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে আইকনিক এই রেলস্টেশন। জানুয়ারি থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বহু প্রতীক্ষার যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে। দৈনিক একটি ট্রেন ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা করে ঢাকা বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিয়ে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে কক্সবাজার পৌঁছাবে। কক্সবাজার থেকে দুপুর ১টায় যাত্রা করে রাত ৯টা ১০ মিনিটে ফিরবে ঢাকায়। ফিরতি পথেও চট্টগ্রাম এবং ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রা বিরতি করবে। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে ট্রেনটির।
এ ছাড়া শুরুর দিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যাতায়াত করবে দুটি ট্রেন। চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রেন ছাড়বে সকাল ৭টায়, এটি কক্সবাজার পৌঁছাবে সকাল ১০টা ২০ মিনিটে। দ্বিতীয় ট্রেনটি বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে ছেড়ে কক্সবাজার পৌঁছাবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
অন্যদিকে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের পথে প্রথম ট্রেনটি ছেড়ে যাবে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে, যেটি চট্টগ্রামে পৌঁছাবে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে। দ্বিতীয় ট্রেননি সন্ধ্যা ৭টায় কক্সবাজার থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে রাত ১০টা ৫ মিনিটে। এসব ট্রেন রামু, ডুলহাজারা, চকরিয়া, সাতকানিয়া, দোহাজারী, পটিয়া, জানআলী হাট, ষোলশহর স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করাবে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় বেড়ে হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।