June 14, 2025 - 1:51 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeস্বাস্থ্য-লাইফস্টাইল২০০ বার সাপের ছোবল খাওয়া ব্যক্তির রক্ত থেকে অ্যান্টিভেনম

২০০ বার সাপের ছোবল খাওয়া ব্যক্তির রক্ত থেকে অ্যান্টিভেনম

spot_img

অনলাইন ডেস্ক : ইচ্ছাকৃতভাবে ২০০ বারের বেশি সাপের কামড় খেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ট্রিম ফেড। গোখরাসহ বিশ্বের ভয়ঙ্কর নানা সাপের বিষ ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে নিয়েছেন ৭০০ বারের বেশি।

টিম ফ্রিডের এক সময় ট্রাক সারাই ছিল পেশা। পরে সাপ নিয়ে কাজ করা হয়ে যায় নেশা। শুরুতে তিনি নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চেয়েছিলেন যাতে সাপ ধরার সময় তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেন এবং নিজের এই কীর্তিকলাপ তিনি ভিডিও করে ইউটিউবে রেকর্ড করে রাখতেন।

তিনি বিষ সংগ্রহ করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক কিছু সাপ থেকে, যার মধ্যে রয়েছে একাধিক প্রজাতির মাম্বা, কোবরা, তাইপান ও ক্রেইট।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, টিম ফ্রিডের রক্তে এমন এক ধরনের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে যা মারাত্মক ধরনের বিষের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। টিমের রক্তে পাওয়া অ্যান্টিবডি প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় দেখা গেছে এই অ্যান্টিবডি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে সাপের বিষের মারাত্মক ডোজ থেকে রক্ষা করেছে।

সাপের বিষ কাটাতে বর্তমানে যে থেরাপিগুলো প্রচলিত আছে তা নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষ অনুযায়ী কাজ করে, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিকে যে সাপ কামড়েছে, সেই প্রজাতির সাপের জন্য তৈরি অ্যান্টিভেনমই দিতে হয়।

ফ্রিডের ১৮ বছরের প্রচেষ্টা সব ধরনের সাপের কামড়ের বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন অ্যান্টিভেনম খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

প্রায় দুই দশক ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরে সাপের বিষ নিচ্ছেন টিম ফ্রিড। তবে এসব শুরুর আগে গোখরার দুটি কামড় খেয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। “আমি মারা যেতে চাইনি, আমার একটি আঙুলও হারাতে চাইনি। কাজ করতে পারবো না এমন পরিস্থিতির শিকার হতে চাইনি আমি,” বলছিলেন টিম।

প্রায় ১৮ বছর ধরে টিম ফ্রিড যে কাজ করছেন, তার ফলে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় একটি সার্বজনিন ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেখানে সাপের কামড়ে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজারেরও মতো মানুষের মৃত্যু হয় এবং এর তিনগুণেরও বেশি মানুষ অঙ্গ কেটে ফেলা বা স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়।

ফ্রিড বলেন, তার লক্ষ্য ছিল বিশ্বের অন্যান্য মানুষের জন্য ভালো থেরাপি তৈরি করা। “এটা একসময় আমার জীবনযাত্রার অংশ হয়ে যায়। আমি নিজেকে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকি—তাদের জন্য, যারা আমার থেকে আট হাজার মাইল দূরে সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছে।”

‘তোমার রক্ত আমরা পেতে চাই’
বর্তমানে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয় ঘোড়ার মতো প্রাণীদের শরীরে সাপের বিষের ছোট ছোট ডোজ ইনজেকশন দিয়ে প্রয়োগ করার মাধ্যমে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সেই বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে যা সংগ্রহ করে থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু বিষ এবং অ্যান্টিভেনমকে একে অন্যের সাথে মিলিয়ে দিতে হয়, কারণ একেক প্রজাতির সাপের বিষ একেক রকম হয়ে থাকে।

আবার একই প্রজাতির সাপের মধ্যেও অঞ্চল ভেদে নানা বৈচিত্র্য থাকে, বিষে পার্থক্য থাকে—যেমন, ভারতের সাপ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনম শ্রীলঙ্কার সেই একই প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে কম কার্যকর। এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা খুঁজতে থাকেন এমন এক ধরনের অ্যান্টিবডি যাকে বলে ‘ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি বলা হয়—যা বিষের নির্দিষ্ট অংশ নয়, বরং সব ধরনের বিষে থাকা সাধারণ অংশগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে।

এই সময়ই সেন্টিভ্যাক্স নামের বায়োটেক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ড. জ্যাকব গ্লানভিল খোঁজ পান টিম ফ্রিডের।

তিনি বলেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে ভাবলাম—বিশ্বে যদি কারও শরীরে এমন ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে থাকে, তবে সেটা টিমের শরীরেই তৈরি হয়েছে। তাই আমি যোগাযোগ করলাম। প্রথম ফোনেই বললাম, ‘বিষয়টা অদ্ভুত শোনালেও, তোমার কিছু রক্ত পেলে খুব ভালো হতো।”

ফ্রিড রাজি এতে হন এবং গবেষণাটি নৈতিক অনুমোদন পায়। কারণ এই গবেষণায় তাকে আর বিষ দেওয়া হয়নি, কেবল রক্ত নেওয়া হয়েছে।

গবেষণাটি মূলত ইলাপিডস নামের বিষাক্ত প্রজাতির সাপের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। ইলাপিডস হলো বিষধর সাপের দুটি গোত্রের মধ্যে একটিতে অন্তর্ভুক্ত। যার মধ্যে রয়েছে কোরাল সাপ, মাম্বা, কোবরা বা গোখরা, তাইপান ও ক্রেইট।

ইলাপিডসরা মূলত তাদের বিষে নিউরোটক্সিন ব্যবহার করে, যা তাদের শিকারকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পেশি স্থবির করে ফেলে যা ওই প্রাণীর মৃত্যুর কারণও হয়।

গবেষকরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিহ্নিত সবচেয়ে মারাত্মক ১৯টি ইলাপিডস প্রজাতির ওপর পরীক্ষা করেন এবং এই বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে তারা ফ্রিডের রক্ত পরীক্ষা শুরু করেন।

বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সেল’-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, তারা দুটি ব্রডলি নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি শনাক্ত করেছে, যা দুটি আলাদা নিউরোটক্সিন শ্রেণিকে লক্ষ্য করে কাজ করতে পারে।

তৃতীয় একটি বিষের জন্য তারা ওষুধ যোগ করে তৈরি করেন একটি অ্যান্টিভেনম ককটেল।

ইঁদুরের ওপর করা পরীক্ষায় দেখা যায়, এই ককটেল ১৯ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের মধ্যে ১৩টি সাপের মারাত্মক বিষ থেকে তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাকি ছয়টির বিরুদ্ধে আংশিক সুরক্ষা দিয়েছে।

ড. গ্লানভিল বলেন, এই অ্যান্টিভেনম “অতুলনীয়”, কারণ এটি এমন বহু ইলাপিডস প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে কাজ করে, যেগুলোর জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর অ্যান্টিভেনম নেই। গবেষক দলটি অ্যান্টিবডিগুলোকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করছে এবং দেখছে যদি চতুর্থ একটি উপাদান যোগ করা যায়, তাহলে ইলাপিড প্রজাতির সাপের বিষের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে কি না।

সাপের আরেকটি প্রজাতি হলো ভাইপার, যাদের বিষ সাধারণত হিমোটক্সিন হয়, যা রক্তকে আক্রমণ করে—এসব সাপের বিষ নিউরোটক্সিন নয়।

সব মিলিয়ে সাপের বিষে প্রায় এক ডজন ভিন্ন ধরনের টক্সিন বা বিষাক্ত উপাদান থাকে, যার মধ্যে সাইটোটক্সিনও রয়েছে—যা সরাসরি কোষ ধ্বংস করে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক পিটার কোয়াং বলেন, “আমার ধারণা, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আমরা প্রতিটি শ্রেণির বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু পেয়ে যাব।” এবং ফ্রিডের রক্তের নমুনা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।

অধ্যাপক কোয়াং আরও বলেন, “টিমের অ্যান্টিবডিগুলো সত্যিই অসাধারণ—সে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শিখিয়েছে কীভাবে খুব বিস্তৃতভাবে বিষকে চিনতে হয়।”

চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, এমন একটি একক অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যা সব বিষের বিরুদ্ধে কাজ করবে, অথবা ইলাপিডের জন্য একটি ইনজেকশন এবং ভাইপারের জন্য একটি ইনজেকশন।

লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সাপের বিষ বিষয়ক গবেষণা ও চিকিৎসা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নিক কেসওয়েল বলেছেন, এই গবেষণায় সাপের কামড় থেকে সুরক্ষা পাওয়ার যে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা মানুষের জন্য অনেক উপকারী হবে।

এই পদ্ধতি অবশ্যই নতুন এবং এখন পর্যন্ত যেসব তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এই অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা সফল হওয়ার দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে “এখনও অনেক কাজ বাকি আছে” এবং এই অ্যান্টিভেনম মানুষের ওপর ব্যবহারের আগে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন। তবে টিম ফ্রিডের জন্য, এই পর্যায়ে আসা একটি আত্মতৃপ্তির বিষয়।

তিনি বলেন, “আমি মানবতার জন্য ভালো কিছু করছি এবং এটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি এতে গর্বিত। এ এক দারুণ অনুভূতি।” সূত্র-বিবিসি।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ

যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে ৪ কিমি যানজট, ঈদ-পরবর্তী যাত্রায় ভোগান্তি

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: ঈদুল আজহার ছুটি শেষে রাজধানীমুখী মানুষের ঢলে সিরাজগঞ্জ অংশে যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে প্রায় ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার (১৩...

বড়লেখা সীমান্তে বিএসএফ আরও ১৩জনকে পুশইন

তিমির বনিক, স্টাফ রিপোর্টার: মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পাল্লাথল সীমান্ত দিয়ে আরও ১৩ জনকে পুশইন করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শুক্রবার (১৩ই জুন) সকালে তাদের...

নড়াইলে গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার স্বামী শহিদুল পলাতক

উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল: নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় ঘরের পাশ থেকে সালমা আক্তার (৩০) নামে এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করেছে লোহাগড়া থানা পুলিশ। তবে...

সাতক্ষীরা জামায়াতের রুকন প্রার্থী শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত

শহীদুজ্জামান শিমুল, সাতক্ষীরা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক সেক্রেটারী ও খুলনা অঞ্চল পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে...

সাতক্ষীরায় মাদক বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় ১২ জনকে কুপিয়ে জখম

শহীদুজ্জামান শিমুল, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুখরালী দক্ষিণ পাড়া ( খালকান্দা) মাদক বিক্রিতে বাধা দেয়ায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম এবং গ্রামবাসীকে হয়রানীর...

বগুড়ায় বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন

বগুড়া প্রতিনিধি: বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া এলাকায় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে বিদ্যুৎ শেখ (৩০) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার (১৩ জুন) বিকেলে ঈদগাহ...

হালুয়াঘাটে জাম পারার সময় গাছের ডাল ভেঙে নিচে পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

ময়মনসিংহ ব্যুরোঃ ময়মনসিংহের হালু্য়াঘাটে জাম পারার সময় গাছের ডাল ভেঙে নিচে পড়ে কামাল হোসেন ঢালী (৬০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (১৩ জুন) দুপুর...

সোনারগাঁয়ে কোম্পানিকা সেতু রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন

কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক: নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি কোম্পানিকা সেতু রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। শুক্রবার সকালে ‘সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ কমিটি’র উদ্যোগে...